আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ঘিরে সংঘর্ষ থেকে শুরু হওয়া দাঙ্গায় সর্বশেষ পাওয়া খবরে দিল্লিতে নিহতের সংখ্যা ৪২ জন। আহত হয়েছেন চার শতাধিক। বৃহস্পতিবার স্থানীয় একটি নর্দমায় ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) এক কর্মকর্তার লাশও পাওয়া গেছে।
আইবি কর্মকর্তার নাম অঙ্কিক শর্মা। পরিবার বলছে তাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে । এই কমকর্তাকে হত্যার দায়ে দিল্লির ক্ষমতায় থাকা আম আদমি পার্টির কাউন্সিলর তাহির হোসেন ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালেও দিল্লির শিববিহার এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন একজন। বৃহস্পতিবারের সংঘর্ষে আহত আরও ২-৩ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি দোকান ও একটি মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে ।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, সহিংসতার ঘটনা তদন্তে দু’টি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছে। তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ক্রাইম ব্রাঞ্চের হাতে।
বৃহস্পতিবার শেষ রাতের দিকে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গত ৩৬ ঘণ্টায় বড় ধরনের কোনও সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়া এলাকায় ৭০ কোম্পানি আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সহিংসতার ঘটনায় দিল্লি পুলিশ ৪৮টি এফআইআর দায়ের করে। আটক করা হয়েছে ৪ শতাধিক এবং গ্রেফতার করা হয়েছে ১৩০ জনকে।
গেল রবিবার থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে দিল্লি ছাড়া শুরু করেছে মুসলমানরা। গুলি-বোমা-আগুনের সঙ্গে এসিড হামলাও চলে লাগাতার এই সহিংসতায় ।
ভারতীয় গণমাধ্যম বলছে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) সমর্থক-বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হলেও ধীরে ধীরে এটি সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় রূপ নেয় তা। এতে প্রতিদিনই বাড়তে থাকে নিহতের সংখ্যা। বৃহস্পতিবারও অন্তত সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।গত মঙ্গলবার অশোকনগরে এক হাজার জনের একটি গ্রুপ এলাকায় ঢুকে একটি মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় মসজিদে অন্তত ২০ জন নামাজ পড়ছিলেন। অপরদিকে, উত্তর-পূর্ব দিল্লির অশোকনগরে মসজিদে হামলা-অগ্নিসংযোগ করেছে বহিরাগতরা। তারা বেছে বেছে শুধু এলাকার মুসলিমদের বাড়ি ও দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দেয়। স্থানীয় হিন্দুরা জানিয়েছেন, তারা বহিরাগতদের কাউকে চেনেন না এবং এমন পরিস্থিতিতে গৃহহীন মুসলিমদের পাশে থাকবেন সবাই।
দাঙ্গায় উস্কানিমূলক মন্তব্যের অভিযোগে বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার মামলায় কেন্দ্রীয় সরকারকে ৪ সপ্তাহ সময় দিয়েছে দিল্লি হাইকোর্ট। তবে, এফআইআর দায়ের করতে বাড়তি সময় চেয়েছে কেন্দ্র।
এদিকে দিল্লিতে সহিংসতার ঘটনায় ৫৪টি মুসলিম রাষ্ট্রের সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কর্পোরেশনের (ওআইসি) বিবৃতির সমালোচনা ও নিন্দা জানিয়েছে ভারত। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওআইসি’র বক্তব্যকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।বৃহস্পতিবার ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাভিশ কুমার বলেন, ‘ভারতে মুসলিমদের উপর সহিংসতার যে অভিযোগ করেছে ওআইসি, তা দায়িত্বজ্ঞানহীন’। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এখবর জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে এই বিবৃতি প্রকাশ করে ওআইসি। এতে দিল্লিতে মসজিদ ও মুসলিম মালিকানাধীন সম্পত্তি ভাঙচুরের নিন্দা এবং এই সহিংসতার শিকার পরিবারের প্রতি শোক প্রকাশ করা হয়।বিবৃতিতে ওআইসি মুসলিমবিরোধী সহিংসতার জন্য প্ররোচণাকারী ও জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা, মুসলিম নাগরিকের সুরক্ষা এবং সারা দেশে ইসলামি পবিত্র স্থানের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানায়।
দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ঘোষণা দিয়েছেন যে, সহিংসতার ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। নিহত বয়স্ক পরিবারকে ১০ লাখ ও নিহত নাবালক পরিবারকে ৫ লাখ রুপি করে আর্থিক সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।
দিল্লিতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের দ্বারস্থ হয়েছেন সোনিয়া গান্ধী, মনমোহন সিংসহ অন্যান্য নেতারা। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে কংগ্রেসের অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি সোনিয়া গান্ধী বলেন, আমরা রাষ্ট্রপতিকে স্বারকলিপি দিয়েছি। কেন্দ্র ও দিল্লি সরকার নীরব দর্শকের মতো আচরণ করছে। রাষ্ট্রপতি আমাদের দাবি গুরুত্ব সহকারে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, গত চারদিন ধরে দিল্লিতে যা ঘটছে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছি আমরা। খুবই উদ্বেগের বিষয়। এ ধরনের ঘটনা জাতীয় লজ্জা।
গত বছরের ডিসেম্বরে বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পাস করে মোদি সরকার। তারপর থেকেই এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাসের পর থেকেই মুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। সমালোচকদের দাবি, এই আইন ভারতের সংবিধানবিরোধী। এই আইনের কারণে মুসলিমরা আতঙ্কে আছেন যে, মোদির ভারতে তাদের হয়তো দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হবে।
গত শনিবার জাফরাবাদে সিএএ-বিরোধীরা রাস্তা অবরোধ করে। রবিবার থেকে পাল্টা সিএএর পক্ষে সমাবেশ হয়। এরপরেই দু'পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি সংঘর্ষ শুরু হয়। আর এই বিক্ষোভই সংঘাতে রূপ নেয় এবং দিল্লি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই দাঙ্গা পরিস্থিতির মধ্যেই দিল্লি সফর করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সুত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি
সান নিউজ/সালি