নিজস্ব প্রতিবেদক:
বেশ কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে চীনের সিনোভেক কোম্পানির করোনার টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ (ট্রায়াল) নিয়ে। সরকার বলছে, নৈতিক অনুমোদন যথেষ্ট নয়। টিকার প্রয়োগের সিদ্ধান্ত দেবে সরকার।
এরপর কবে মাঠপর্যায়ে টিকার ট্রায়াল শুরু হবে, তা সরকার বা গবেষকেরা বলতে পারছেন না।
বুধবার (২২ জুলাই) সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, চীনের টিকা দেশে প্রয়োগ হবে কি না কিংবা হলেও তা কবে নাগাদ হবে, সে ব্যাপারে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করেই সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
এক দিন আগে মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, টিকার ট্রায়াল দুটি রাষ্ট্রের বিষয়। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় লাগবে।
করোনার টিকা উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বজুড়ে। এ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে আছে যুক্তরাজ্য, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। চীনের যে টিকাটি বাংলাদেশে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের কথা বলা হচ্ছে, তা প্রতিযোগিতার প্রথম সারিতে থাকা তিনটির একটি। চীনের কোম্পানি সিনোভেক এই টিকা উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এ টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করবে। টিকার নাম করোনাভেক।
১৯ জুলাই বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) আইসিডিডিআরবিকে টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের নৈতিক অনুমোদন দেয়। নৈতিক অনুমোদনের অর্থ হচ্ছে বৈজ্ঞানিক নীতির মানদণ্ড মেনে বাংলাদেশের মানুষের শরীরে এ টিকা প্রয়োগ করা হবে। টিকাটি নিরাপদ ও কার্যকর কি না তা দেখা হবে। যদি কোনো ঝুঁকি থাকে তা সামলানোর ব্যবস্থাও আছে গবেষণা কর্মকাণ্ডের মধ্যে।
বিএমআরসির চেয়ারম্যান সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বুধবার (২২ জুলাই) বিকেলে বলেন, ‘নৈতিক অনুমোদন দেওয়ার অর্থ এই নয় যে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমোদন। পরীক্ষামূলক প্রয়োগের সিদ্ধান্ত দেবে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর।’
অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী আরও বলেন, নৈতিক অনুমোদনের বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর অনেকেই ঘটনাটি জানতে চেয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে।
এ টিকাটি চীন থেকে আমদানি ও ব্যবহারের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন দরকার হবে। আবার হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতিরও প্রয়োজন।
আইসিডিডিআরবির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কলেরার টিকার ট্রায়ালসহ আরও নানা ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা আইসিডিডিআরবির আছে। সূত্রগুলো জানিয়েছে, চীনা টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি সব নিয়মনীতি মেনেই কাগজপত্র জমা দিয়েছে। হঠাৎ মন্ত্রণালয় থেকে কথা ওঠায় প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। গণমাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
সূত্র বলছে, বুধবার বিকেল পর্যন্ত চীনের সিনোভেক বায়োটেকের সঙ্গে আইসিডিডিআরবির আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি হয়নি। দুই সপ্তাহ আগেই চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। গত দুই দিনে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বক্তব্যের কারণে চুক্তি ও টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ পিছিয়ে যেতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
করোনার টিকা নিয়ে মানুষের আগ্রহ আছে ব্যাপক। টিকা উদ্ভাবন চেষ্টার পাশাপাশি শত শত কোটি টিকা উৎপাদনেরও প্রস্তুতি চলছে বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশেও টিকা উদ্ভাবনের কাজ যেমন চলছে, তেমনি টিকা উৎপাদনের কথাও আলোচনায় আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও টিকা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, পাশাপাশি টিকা উৎপাদনের জন্য তৈরি হচ্ছে সে দেশের বড় বড় ওষুধ কোম্পানি। আমদানি করা, নাকি উৎপাদন করা বেশি সুবিধাজনক, তা নিয়ে বিভিন্ন দেশে নানা রকম হিসাব–নিকাশ চলছে। বাণিজ্যিক স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কও এসব ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
বুধবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকার বিভিন্ন দেশের টিকার কার্যকারিতার ওপর চোখ রাখছে। দেশের জন্য যা ভালো হবে, সরকার সে রকম সিদ্ধান্তই গ্রহণ করবে।
বিএমআরসি জানিয়েছে, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিট–১, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইউনিট–২ এবং ঢাকা মহানগর হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর এ টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হবে। পরীক্ষা হবে ৪ হাজার ২০০ স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর।
চীনা টিকার এটা তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা। এতে দেখা হবে টিকাটি কতটা নিরাপদ ও কতটা কার্যকর। সিনোভেকের এ টিকার তৃতীয় পর্যায়ে পরীক্ষা সৌদি আরবের আবুধাবিতে শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় পরীক্ষার শুরু করার প্রস্তুতি শেষ। এ পরীক্ষার জন্য করোনার সামাজিক সংক্রমণ পরিস্থিতি বজায় থাকা দরকার হয়। বাংলাদেশসহ এই পাঁচটি দেশে সামাজিক সংক্রমণ চলছে। চীনে বর্তমানে সেই পরিস্থিতি নেই।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমতি দিলে চীন থেকে টিকা আনবে আইসিডিডিআরবি। সেটি কবে নাগাদ হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। এদিকে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশের সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস ঢাকায় চীনের উপরাষ্ট্রদূত ইয়ান হুয়ালংকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিলে চীনা রাষ্ট্রদূত হবেন টিকা গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি।’
সান নিউজ/ আরএইচ