নিজস্ব প্রতিবেদক:
স্বাস্থ্যবিধি, লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, এই শব্দগুলো বাংলাদেশের মানুষের মাঝে যেরকম হঠাৎ করে এসেছিল, তেমনি হঠাৎ করেই চলে গিয়েছে। বাংলাদেশ তথা পুরো বিশ্বে করোনা নামক মহামারী চললেও এদেশের মানুষের যেন তাতে কিছুই আসে যায় না। এপ্রিলের আগের বাংলাদেশ এবং বর্তমান বাংলাদেশের মধ্যে একটাই পার্থক্য, সেটি হল আগে মানুষ মাস্ক পড়ত না, এখন নাম মাত্র মাস্ক পড়ছে। তাও সবাই না।
দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়েছে। এর আগে ১ লাখ ছাড়াতে সময় লেগেছিল ১০৩ দিন আর পরের এক লাখের কাছাকাছি যেতে সময় লেগেছে মাত্র ৩১ দিন। প্রতিদিনের গড় তথ্য বলছে পরবর্তী ১ লাখ ৩২ দিনে ছাড়িয়ে যাবে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিদিনের স্বাস্থ্য বুলেটিনে অধিদফতরের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরামর্শ হিসেবে বলা হয় - স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন, করোনাকে প্রতিরোধ করবেন। সঠিকভাবে মাস্ক পরবেন, বারবার সাবান-পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোবেন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবেন এবং জনসমাবেশ এড়িয়ে চলবেন। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব আর স্বাস্থ্য বিধি, সেটা বাঙ্গালির অন্তরে ঘুমিয়ে আছে।
পৃথিবীর উন্নত সকল দেশ যখন করোনা থেকে বাঁচতে সাধ্যের মধ্যে সব কিছু করতে ব্যস্ত সেখানে আমাদের দেশের মানুষ জীবিকা উপার্জনে মরিয়া। করোনার প্রকোপ বাংলাদেশে এখনও মারাত্মক অবস্থায় আছে। এর মধ্যেও থেমে নেই মানুষের জীবন জীবিকার ছুটাছুটি। লঞ্চ, ট্রেন, বাস, বাজার সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে মানুষের উপচে পরা ভিড়। অথচ কিছুদিন আগেও সব জায়গায় ছিল শুনশান নিরবতা।
রোববার (১৯ জুলাই) সরেজমিনে রাজধানীর নিউ মার্কেট ঘুরে দেখা যায় মানুষের উপচে পড়া ভিড়। ঈদকে সামনে রেখেই চলছে ধূমধাম বেচাকেনা। নিউমার্কেটে লোক সমাগমের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই কারও। মাস্ক ছাড়াই ঘুরছে ক্রেতা, দোকানিরাও কিছু বলছে না। স্বাস্থ্যবিধির চেয়ে বিক্রির দিকে দৃষ্টি বেশি দোকানির, ক্রেতার মাথা ব্যাথা সব দরদাম নিয়ে। নিউমার্কেটে ক্রেতার সমাগমে গাউসিয়া থেকে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে রীতিমত জ্যাম লেগে থাকতে দেখা যায়।
মার্কেটের দোকানগুলোতে বিক্রেতারা মাস্ক পড়ে বসে থাকলেও অনেক দোকানেই নেই হ্যান্ড সেনিটাইজারের ব্যবস্থা। যে যেভাবে পারছেন ক্রেতা ডাকছেন আর পণ্য বিক্রি করছেন। ফুটপাথের হকারদের অবস্থা আরও করুণ। সেখানে সামাজিক দূরত্ব নেই এবং কোনও হকারের মুখে মাস্ক পর্যন্ত নেই।
অপর দিকে বাস বা বাসস্ট্যান্ড কোথাও নেই স্বাস্থ্যবিধির বালাই। একই দিন বিকেলে রাজধানীর শনির আখড়া – যাত্রাবাড়ী এলাকা ঘুরে দেখা যায় বাসে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড়। সরকার নির্ধারিত ৬০% ভাড়া বেশি আদায় করলেও, সরকার নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কাই করছে না বেশীরভাগ বাস চালক ও হেল্পার। কিছু কিছু বাসে যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকতেও দেখা গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চালক মোসলেম মিয়া বলেন, ‘সারা দিন যাত্রী পাই না। অফিস ছুটির এই সময়েই শুধু গাড়িটা ভর্তি করে নিতে পারি। এভাবে না করলে চলে না, জমার টাকা দিয়ে নিজের কিছু থাকে না আজকাল’।
বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা জামিলুর রহমান বাসের অপেক্ষায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উঠার সুযোগ না পেয়ে যাত্রাবাড়ী থেকে পায়ে হেটেই কমলাপুরমুখী হন। তিনি জানান, ‘প্রতিদিন অফিসে আসার সময় এবং বাসায় যাওয়ার সময় বাসের সঙ্কট দেখা যায়। আর স্বাস্থ্যবিধি তো চোখেই পড়ে না।’ তিনি আরো বলেন, অফিস আওয়ারে সব সময়েই বাসে চাপ থাকে। এ ব্যাপারটি মাথায় রেখে সরকারের উচিৎ এই সময়টার জন্য স্ট্যান্ডগুলোতে বিআরটিসি বাস দেওয়া। এতে করে বাসে যাত্রীর চাপ কমতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
অপরদিকে কমলাপুর রেল স্টেশনে যাত্রীর চাপ তুলনামূলক কম থাকলেও আগামী দুই তিন দিনের মধ্যে ঈদ উপলক্ষে যাত্রীর চাপ বাড়বে বলে জানান স্টেশন কর্তৃপক্ষ।
লঞ্চ ঘাটেরও একই অবস্থা। আপাতত যাত্রীর চাপ কিছুটা কম লক্ষ্য করা গেলেও দুই তিন দিনের মধ্যেই লঞ্চঘাটগুলোতে যাত্রীর চাপ অনেক বেশি বাড়তে পারে বলে জানা গেছে।
যদিও বাসের মত লঞ্চ-ট্রেনেও স্বাস্থ্যবিধির তেমন বালাই নেই। সব যায়গাতেই সবার কেমন গা ছাড়া ভাব। সাধারণ মানুষের এই উদাসীনতা দেশকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মানলে এই মাসের শেষ দিকে করোনার সংক্রমণ কমতে শুরু করবে। কিন্তু সামনের দিনে সংক্রমণ বৃদ্ধির বড় কারণ হতে পারে ঈদুল আজহা। ঈদ উপলক্ষে বিপুলসংখ্যক মানুষের অবস্থানের স্থানান্তর, কোরবানি পশু ক্রয় ও জবাইকরণ, গোশত বিতরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। এর ফলে করোনার সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা থেকে যায়।
কোরবানির ঈদকে ঘিরে করোনা সংক্রমণের বড় ভয় রয়েছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। দেশে শনাক্ত কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২ হাজার ৬৬। শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৭০৯ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানানো হয়। ঈদ উপলক্ষে বিপুল মানুষ পরস্পরের সংস্পর্শে আসবে। ঈদযাত্রায়ও পারস্পরিক সাহচর্যে যাবে।
এ অবস্থায় গণপরিবহন বন্ধ রাখারও পরামর্শ দেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ পরামর্শকে আমলে নিয়ে প্রথমে গণপরিবহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়। পরে সে সিদ্ধান্ত বদল করে গণপরিবহন চালু রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, অবাধ সুযোগ পেলে এবারের ঈদযাত্রায় অন্তত ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়তে পারে। গত ঈদে আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়িতে যেতে পারেননি নগরবাসী। তথাপি ফেরিতে, রিজার্ভ বাহনে চড়ে ঢাকা ছাড়েন। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সে সময় ফেরিতে গাদাগাদি করে চলাচলের দৃশ্য দেখে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার উপচেপড়া ভিড় থাকবে। কঠিন হয়ে যাবে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করা। করোনার লাগাম টেনে না ধরতে পারলে সংক্রমণ উচ্চমাত্রায় পৌঁছে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
অবশ্য এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গণপরিবহন বন্ধের সুপারিশ ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচল অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আসন্ন ঈদে জনসমাগম যে কোনো মূল্যে এড়িয়ে চলতে হবে। সরকারের সিদ্ধান্তের অপব্যবহার না করতে পরিবহন মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ঈদযাত্রায় প্রত্যেককে নিজের সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। পশুহাট-লঞ্চ-বাস-ট্রেন স্টেশন-ফেরিঘাট-শপিংমলসহ বিভিন্ন জায়গায় সামাজিক দূরত্ব মানার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। মাস্ক পরিধান অবশ্যই করতে হবে।
এ নিয়ে পরিবহনকর্মীরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন চলাচলের জন্য দেওয়া সরকারি নির্দেশনা বাস্তবে মানা কঠিন। সরকারের সিদ্ধান্তের অপব্যবহার না করতে পরিবহন মালিকদের প্রতি সড়কমন্ত্রীর আহ্বান কতটা বাস্তবে প্রতিফলন ঘটবে তা-ও দেখার বিষয়।
সান নিউজ/ বি.এম.