সান নিউজ ডেস্ক: করোনার নমুনা পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগের মামলায় জেকেজি হেলথকেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী এবং তার স্বামী ও প্রতিষ্ঠানটির সিইও আরিফুল চৌধুরীসহ আটজনকে ১১ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে প্রত্যেককে ১১ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: নৌকার সমর্থক নিহত, বিদ্রোহী প্রার্থী আটক
মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণার সময় আসামিদের সবাই আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
রায়ের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে আদালত প্রাঙ্গণে ডা. সাবরিনা চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। একটা কথাই বলবো। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই আছেন। একদিন মানুষ জানবে সাবরিনার অপরাধ ছিলো না। আমার আর কিছু বলার নেই।
আরও পড়ুন: স্কুলের জমিতে প্রধান শিক্ষকের বাড়ি!
সাজা বেশি হয়ে গেছে মন্তব্য করে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চাকরিচ্যুত চিকিৎসক ডা. সাবরিনা বলেন, আমি চেয়ারম্যান ছিলাম না— এই সাজা কীভাবে হলো? কী হবে বুঝতে পারছিলাম, কিন্তু এতটা হবে বুঝতে পারিনি।
তিনি আরও বলেন, আমি তো সেদিনই মরে গেছি। যেদিন আমাকে এখানে ঢুকানো হয়েছে। আমি বের হবো কি না সেটা বড় কথা না। বড় কথা হলো দেশবাসী জানলো আমি অপরাধী।
আরও পড়ুন: কিশোরীকে অপহরণের পর ধর্ষণ
এর আগে ডা. সাবরিনা শারমিন হুসাইন ওরফে সাবরিনা আরিফ চৌধুরী জেকেজি হেলথ কেয়ারের দুর্নীতির খবর ফাঁসের পর স্বামীর এই সংস্থার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছিলেন। তখন তিনি দাবি করেন, জেকেজির অনিয়মের খবর তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়েছিলেন।
হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার সাবরিনা বলেন, ‘আমি হাসপাতালেই আছি। কোথাও পালিয়ে যাইনি। আপাতত এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। ডিরেক্টর স্যার যদি বলেন তাহলেই আমি আমার বক্তব্য দিব। আমি একাধিকবার বিষয়টি স্পষ্ট করেছি।’
আরও পড়ুন: সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীসহ আহত শোভন
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ডিজি স্যারকে জানিয়েছিলাম যে আমি এটার সঙ্গে নেই। আমি স্বেচ্ছাশ্রমটুকুই সেখানে দিতাম। ওইটুকুও দিব না। সেখানে অনৈতিক কোনো কিছু হচ্ছে, সেটা আমি জানতাম না। এটার (জেকেজি) কার্যক্রমগুলো যে সিস্টেমিক ওয়েতে যাওয়ার কথা সেভাবে হচ্ছিল না। এটা আমি সবাইকে জানিয়েছি যে এটার ব্যবস্থাপনায় আমি নেই।’
এর আগে ২০২০ সালের জুন মাসের শুরুতে তিতুমীর কলেজের কর্মচারীদের সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীদের মারামারির সময় সাবরিনা জেকেজির হয়ে কথা বলেছিলেন এবং ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেনও। কিন্তু মাসের শেষ দিকে জেকেজির দুর্নীতির খবর প্রকাশ পাওয়ার পর তিনি দাবি করেন, এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত দুই মাস ধরে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
আরও পড়ুন: একদিন মানুষ জানবে, আমি নিরাপরাধ
জেকেজির চেয়ারম্যান পদে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবরিনা বলেন, তিনি কোনোদিন এই প্রতিষ্ঠানের মালিক বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কোনো পদে ছিলেন না। কিন্তু আজ আদালতের রায়ে প্রমাণিত হয় তার এসব বক্তব্য সত্য ছিল না।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনা শনাক্তের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই জেকেজি হেলথকেয়ার ২৭ হাজার মানুষকে রিপোর্ট দেয়। এর বেশিরভাগই ভুয়া বলে ধরা পড়ে। এ অভিযোগে ২০২০ সালের ২৩ জুন অভিযান চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেওয়া হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা করা হয় এবং দুজনকে গ্রেফতার করা হয়।
আরও পড়ুন: বৃদ্ধার বাড়ি লিখে নিল মেম্বার
পরদিন ২৪ জুন জেকেজির সাবেক গ্রাফিক্স ডিজাইনার হুমায়ুন কবীর হিরু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারী ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। হিরু স্বীকারোক্তি দিয়ে জানান, তিনি ভুয়া করোনা সার্টিফিকেটের ডিজাইন তৈরি করতেন, যার সঙ্গে জেকেজি গ্রুপের লোকজন জড়িত। ওই তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ জেকেজির সিইও আরিফুলসহ চারজনকে আটক করে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরীর জ্ঞাতসারেই সব কিছু হয়েছে বলে পুলিশকে জানান আটক ব্যক্তিরা।
একই বছরের ১২ জুলাই সাবরিনাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনি জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। সাবরিনা আরিফের চতুর্থ স্ত্রী। তার প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী রাশিয়া ও লন্ডনে থাকেন। তৃতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তালাক হয়েছে তার। চতুর্থ স্ত্রী ডা. সাবরিনার কারণেই করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজ পায় জেকেজি হেলথকেয়ার।
আরও পড়ুন: তেহরানে পুতিন-এরদোয়ান
প্রথমে তিতুমীর কলেজ মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ৪৪টি বুথ স্থাপন করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। নমুনা সংগ্রহের জন্য মাঠকর্মী নিয়োগ দেন তারা। তাদের হটলাইন নম্বরে রোগীরা ফোন দিলে মাঠকর্মীরা বাড়ি গিয়ে এবং বুথ থেকেও নমুনা সংগ্রহ করতেন। এভাবে নমুনা সংগ্রহ করে তারা ২৭ হাজার রোগীকে করোনা টেস্টের রিপোর্ট দেন, যার মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনা আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ জনের রিপোর্ট প্রতিষ্ঠানটি জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করে। প্রতিটি সার্টিফিকেটের বিনিময়ে তারা ৫ হাজার টাকা করে নিয়েছেন।
পরে গত বছরের ৫ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে দুপুরে সাবরিনা ও আরিফসহ আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী। চার্জশিটে জেকেজি হেলথ কেয়ারের কম্পিউটারে এক হাজার ৯৮৫টি ভুয়া রিপোর্ট ও ৩৪টি ভুয়া সার্টিফিকেট জব্দের কথা বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন: সাবরিনা-আরিফের ১১ বছরের কারাদণ্ড
চার্জশিটভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন— আবু সাঈদ চৌধুরী, হুমায়ূন কবির হিমু, তানজিলা পাটোয়ারী, বিপ্লব দাস, শফিকুল ইসলাম রোমিও ও জেবুন্নেসা। চার্জশিটে সাবরিনা ও আরিফকে প্রতারণার মূলহোতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাকিরা প্রতারণা ও জালিয়াতি করতে তাদের সহযোগিতা করেছেন।
সান নিউজ/কেএমএল