স্বাস্থ্য

স্বাস্থ্য গবেষণায় পিছিয়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত কিছুটা উন্নতি হলেও পিছিয়ে রয়েছে গবেষণায়। বরাদ্দ স্বল্পতা, অবকাঠামোগত সমস্যা, প্রয়োজনীয় জনবল এবং গবেষকদের মূল্যায়ন না থাকায় আগ্রহ হারাচ্ছেন চিকিৎসকরা। ফলে দেশের মানুষের কল্যাণে চিকিৎসা গবেষণায় উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পারছে না বলে অভিমত গবেষকদের।

তাদের আরও অভিমত, বর্তমানে দেশে স্বাস্থ্য বাজেটের অনুন্নয়ন ব্যয় ৬০ শতাংশের ওপর। এ অর্থ চলে যাচ্ছে মূূলত ভৌত অবকাঠামো, পরিচালন খাত ও সংশ্লিষ্টদের বেতন-ভাতায়। প্রকৃতপক্ষে গবেষণার জন্য বরাদ্দ খুবই কম। যদিও করোনাকালে স্বাস্থ্য বাজেট ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশেরও কম। এটা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৫২টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। স্বাস্থ্য খাতে ২০২০-২১ সালে বরাদ্দ মোট বাজেটের আকারের তুলনায় মাত্র ৫ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হতে হবে দেশের জিডিপির ৫ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ।

দেশে চিকিৎসা খাতে উল্লেখযোগ্য গবেষণা না থাকায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত আক্ষেপ প্রকাশ করেন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কুমুদিনি ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্স অ্যান্ড ক্যানসার রিসার্চের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমাদের দেশে রিসার্চের সুযোগ কম, বিশেষ করে মেডিকেল সায়েন্সে রিসার্চ হচ্ছে না, যেটা হওয়া একান্ত প্রয়োজন। যাদের রিসার্চ করার কথা, তারা সবাই ডাক্তার হয়ে রোগী দেখতে ব্যস্ত। ফলে তাদের পাবলিকেশন ও রিসাচ খুব কম হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) করা হয়। বর্তমানে আরও কয়েকটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল করতে যে যন্ত্র লাগে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মতো এগুলোতেও ট্যাক্স প্রত্যাহার করা হয়েছে। চিকিৎসা গবেষণায় বেসরকারি উদ্যোগে সরকারের সহযোগিতা থাকবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুদান দেয়। কিন্তু এর আগে বিএসএমএমইউ ছাড়া কোনো মেডিকেল কলেজ এটি পেত না। ফলে চিকিৎসকদের বিএমআরসি অথবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হতে হতো। তবে চলতি বছর প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসা গবেষণায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এটি ব্যবহারের নীতমালা শেষ হয়েছে এ বছরের মে মাসে। ইতোমধ্যে গবেষণার জন্য বেশ কয়েকটি প্রকল্প জমা হয়েছে। এখন মূল্যায়ন চলছে। এটা হলে চিকিৎসা খাতে গবেষণা পরিধি বাড়বে।

বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) পরিচালক ডা. মোহাম্মাদ রুহুল আমিন বলেন, দেশের চিকিৎসা গবেষণা খাত উন্নয়নে বিএমআরসির যে পরিমাণ ভূমিকা রাখার কথা ছিলো, তার দশ ভাগও রাখতে পারছে না। বিদেশে সরকারিভাবে যেসব রিসার্চ ইনস্টিটিউট আছে, সেখানে যে কোনো সময় বড় বড় গবেষণা করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে বিএমআরসির যে মনিটরিং বা ফান্ড দরকার তা নেই। প্রতিষ্ঠানটির অর্থ সংকট এতটাই যে, বছরে দু-একটা গবেষণা করছে, তা দিয়ে সারা বাংলাদেশ কভার করা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, একটা রোগ নিয়ে গবেষণা করতে হলে দেশের অন্তত কয়েকটা গ্রাম ও শহরের কিছু এলাকায় পর্যবেক্ষণের দরকার হয়। এজন্য বিএমআরসির কোনো ফান্ড নেই। ফলে প্রতিষ্ঠানটির যেভাবে ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিলো সেভাবে পারছে না।

বিএমআরসির সূত্র জানায়, ২০২১-২২ বাজেটে বিএমআরসির জন্য দশ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে সব স্টাফদের বেতন দিতে হয়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালানো, মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ছোটখাটো গবেষণার জন্য থিসিস গ্রান্ট বা মুঞ্জরি দিতে হয়। ফলে বড় গবেষণা করার মতো তেমন সক্ষমতা থাকে না। তা ছাড়া মেডিকেল শিক্ষক-চিকিৎসকরাও তেমন গবেষণায় আগ্রহী নন।

আরেকটি ব্যাপার গবেষণার জন্য আইসিডিডিআরবির মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যে ধরনের অত্যাধুনিক ল্যাব আছে। সেখানে ড. ফেরদৌসি কাদরীর মতো দেশিয় বিজ্ঞানীর গবেষণা করে সারাবিশ্বে সুনাম অর্জন করছেন। অন্যদিকে বিএমআরসির মতো সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কোনো উন্নত ল্যাবরেটরি নেই।

এছাড়া দেশে সরকারি-বেসরকারিভাবে ৩০টির মতো পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিকেল ইনস্টিটিউট থাকলেও তাদের উল্লেখযোগ্য গবেষণা হচ্ছে না।

চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, চিকিৎসকদের মধ্যে যারা শিক্ষক-গবেষক হতে চায়। তারা যতদিন পর্যন্ত যথাযথ প্রণোদনাসহ নন-প্র্যাক্টিসিং বা ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের মাধ্যমে শিক্ষা এবং গবেষণায় পূর্ণ মনোনিবেশ না করবে ততদিন পর্যন্ত চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য গবেষণা আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না।

চিকিৎসা খাতে গবেষণা কম হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যাপক বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে বিএসএমএমইউ ও আইসিডিডিআরবি’র সঙ্গে চীনা টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে আগ্রহী হয়। কিন্তু অর্থায়নের শর্তারোপ করায় তা এগোয়নি।

মহামারি শুরুর পর গত বছরের ২ জুলাই ওষুধ প্রস্তুতকারী গ্লোব ফার্মার সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক টিকা তৈরির কাজ শুরুর কথা জানায়। ৬ থেকে ৭ মাসের মধ্যে এই টিকা বাজারে আনা যাবে বলেও আশা প্রকাশ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেট তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু দীর্ঘ ৬ মাস পর গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডকে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য করোনাভাইরাসের টিকা উৎপাদনের অনুমতি দেয়। দেশের ক্রান্তিকালে একটা প্রতিষ্ঠান সাহস করে এগিয়ে এলেও সরকারের ধীরগতির কারণে সেটি মুখ থুবড়ে পড়েছে।

মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় : দেশে বর্তমানে ৩৬টি সরকারি ও ৬৯টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। পাশাপাশি অনুমোদন আছে ৫টি সরকারি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের। এর মধ্যে শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া কোনো মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা হচ্ছে না। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিভুক্তকরণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল নিয়োগ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। ফলে গবেষণা কার্যক্রমে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর মধ্যেও কিছু মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসক কাজ করলেও নানা কারণে তা সহজে আলোর মুখ দেখছে না।

খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুল আহাদ বলেন, গবেষণার জন্য কলেজের অনেক শিক্ষকই আগ্রহী। করোনাকাালে একাধিক শিক্ষক কয়েকটি ওষুধ নিয়ে থিসিস করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত অর্থ সংকটের কারণে কার্যক্রম এগোয়নি।

তিনি বলেন, আমাদের নিজস্ব কোনো ফান্ড নেই। গবেষণা কেন্দ্র নেই। হাসপাতালকেই গবেষণা কেন্দ্র নির্ধারণ করতে হয়। গবেষণার বিষয় জানানোর পর অর্থের জন্য আবেদন করে বিএমআরসির দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। গত ৬ মাসে দুজন শিক্ষকের আবেদন পাঠানো হয়েছে। এখনো কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। এভাবে শিক্ষকরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে হলে লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল খান বলেন, ‘সিএমইউ প্রতিষ্ঠার পর ১৫৯টি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। প্রথম বছরে ২৫টি, দ্বিতীয় বছরে ৬৫টি এবং তৃতীয় বছরে ৬৯টি গবেষণা করেছেন শিক্ষকরা। তবে গবেষণার জন্য বিএমআরসি থেকে ফান্ড নিতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় শিক্ষকদের। বিএমআরসি যদি গবেষণার ফান্ডটা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বণ্টন করলে শিক্ষকরা গবেষণায় আরও উদ্বুদ্ধ হবে। প্রায় দুই বছর হলো রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করেছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির অধীনে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো অধিভুক্ত করা হচ্ছে। তবে সেখানে শতবর্ষী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) থাকলেও সেবা খাতে অবদান রাখার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা নেই।

রামেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নওশাদ আলী জানান, মেডিকেলে সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতির জন্য তিনটি মৌলিক গবেষণা থাকতে হয়। এই গবেষণার বিষয়বস্তু জাতীয় স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বর্তমানে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে সহকারী থেকে সহযোগী অধ্যাপক হওয়ার জন্য গবেষণা করছেন প্রায় ১৫০ জন।

এছাড়া অধ্যাপক হওয়ার জন্য গবেষণা করছেন ৬০ থেকে ৭০ জন সহযোগী অধ্যাপক। অধ্যাপক হতে হলে ৫টি গবেষণা থাকতে হবে। কিন্তু গবেষণায় সরকারি কোনো বাজেট নেই। বিএমআরসি বর্তমানে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে। এক্ষেত্রে শিক্ষকরা গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য কাউন্সিলে উপস্থাপন করে। কাউন্সিল যাচাই-বাছাই করে অর্থ বরাদ্দ করে। তবে এখনো রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কেউ তা পায়নি।

এর বাইরে বিএসএমএমইউ ও বিসিবিএস কিছুটা সহায়তা করে। যেখানে টাকার অঙ্ক সর্বনিম্ন ৫০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ৫ লাখ। এ টাকাও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কেউ এখনো পায়নি। এ জন্য যোগাযোগ করা হচ্ছে।

সান নিউজ/এফএআর

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

সবজির বাজারে স্বস্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে কমেছে পেঁয়াজ, সবজি...

বড় দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলেন পূজা 

বিনোদন ডেস্ক: ঢাকাই চিত্রনায়িকা ও মডেল পূজা চেরি ডজনখানেক ছব...

স্বামীকে মৃত দেখিয়ে মামলা, নারী আটক

জেলা প্রতিনিধি : সাভারের আশুলিয়ায় জীবিত স্বামীকে বৈষম্যবিরোধ...

বৈষম‌বিরোধী আন্দোলনে বেঁচে ফেরার আশা করেনি

নিজস্ব প্রতিবেদক: ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন আন্দোল&zwnj...

ইসলামী ব্যাংকের সাথে হাব-এর মতবিনিময়

নিজস্ব প্রতিবেদক: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি-এর উদ্যোগে হ...

ফের হারলো সাকিবের দল

স্পোর্টস ডেস্ক : আবুধাবির টি-টেন টুর্নামেন্টে ফের হারের মুখ...

নোয়াখালীতে দুই গৃহবধূর লাশ উদ্ধার

নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালীতে পৃথক স্থান থেকে দুই গৃহবধূর...

ঢাকাবাসীকে নিরাপদ রাখতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকাবাসীকে যেকোনো উপায়ে নিরাপদ রাখতে হবে...

নলছিটিতে ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু

ঝালকাঠি প্রতিনিধি: ঝালকাঠির নলছিটিতে শুরু হয়েছে ভূট্টো স্মৃত...

ডেঙ্গুতে আরও ১০ জনের প্রাণহানি 

নিজস্ব প্রতিবেদক : সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্ট...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা