আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
বিশ্বজুড়ে এখন একমাত্র আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। এই ভাইরাস বিশ্বের ২১২টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। এর ধ্বংসযজ্ঞ ইতিমধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্স।
এসব দেশের পাশাপাশি অন্যান্য দেশেও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে এই ভাইরাস। বিশ্বব্যাপী প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে এই ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।
করোনাভাইরাস মহামারী সূচনার পর থেকেই আলোচনায় উঠে আসে একশ’ বছর আগের ভয়ঙ্কর মহামারী স্প্যানিশ ফ্লু। ওই মহামারী থেকে থেকে শিক্ষা নিতে পারে বর্তমানে করোনা আক্রান্ত বিশ্ব।
সর্বকালের সবচেয়ে ভয়াবহ ওই মহামারীর অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে- শেষ পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব বিধি মেনে চলা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকর সামাজিক দূরত্ব বিধির মাধ্যমে চলমান করোনার মহামারী থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
তবে এটাই একমাত্র সমাধান নয়। স্প্যানিশ ফ্লুর সময়ের সামাজিক দূরত্ব বিধির অভিজ্ঞতা থেকে আনুষঙ্গিক আরও অন্তত পাঁচটি শিক্ষা কাজে লাগানো যায়।
এক: মহামারী সম্পূর্ণভাবে নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত বিধি লঙ্ঘন করা যাবে না : স্প্যানিশ ফ্লুর প্রথম প্রকোপ শুরু হয় ১৯১৮ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের কানসাসে। সেই সময় এ মহামারীর মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের বহু রাজ্য ও শহরই জনগণকে বেশকিছু বিধিনিষেধ মেনে নির্দেশনা দিয়েছিল।
ওইসব নির্দেশনাকেই এখন সামাজিক দূরত্ব বলা হচ্ছে। স্প্যানিশ ফ্লু থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল-কলেজ, হোটেল-রেস্তোরাঁ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। নিষিদ্ধ করা হয়েছিল জনসমাবেশ। জনগণকে বলা হয়েছিল আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনে থাকতে।
কিছু কিছু এলাকায় কয়েক মাস ধরে স্থায়ী ছিল এসব বিধিনিষেধ। এতে কাজও হয়েছিল বেশ; কিন্তু সব এলাকাতেই এ বিধি ভালোভাবে মানা হয়নি। সবসময় বিশেষজ্ঞ ও সরকারি নির্দেশনা মেনে চলেনি জনগণ। এর ফলে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। কোনো কোনো শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। গবেষণাতেও প্রমাণিত হয়েছে, স্প্যানিশ ফ্লুর বিস্তাররোধ ও মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সহায়তা করেছিল সামাজিক দূরত্ব বিধি। করোনা মহামারী মোকাবেলায় একশ’ বছর আগের এ নীতিই এখন অনুসরণ করার নির্দেশ দিচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
দুই: দ্রুত, টেকসই ও পর্যায়ক্রমে পদক্ষেপ বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল : বিশ্লেষকরা বলছেন, এটাই সম্ভবত স্প্যানিশ ফ্লুর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা।
মহামারীর মোকাবেলায় আমাদের দ্রুত, টেকসই ও একের পর এক কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। ভাইরাসটি সম্পূর্ণরূপে বিদায় না নেয়া পর্যন্ত হাল ছাড়া যাবে না; যা কিছু করার সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই করতে হবে।
২০০৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় ১৯১৮ সালের মহামারীর বিরুদ্ধে সফলতার তিনটি উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমত, পদক্ষেপগুলো ছিল খুব দ্রুত অর্থাৎ ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আগেই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়; দ্বিতীয়ত, পদক্ষেপগুলো টেকসই ও স্থায়ী। মানে ভাইরাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব মানা হয়েছিল।
বিধিনিষেধ শিথিল করা হলেও নতুন করে সংক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বহাল করা হয়; তৃতীয়ত, মানুষকে শুধু ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়াই যথেষ্ট নয়। কারণ মানুষের সামাজিক বিধিনিষেধ ভঙ্গ করার প্রবণতা রয়েছে। এজন্য একের পর এক কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এর ফলে বেঁচে গিয়েছিল অগণিত মানুষের প্রাণ।
তিন: তড়িঘড়ি করে বিধিনিষেধ শিথিল করা শহরগুলোতে ফের সংক্রমণ ছড়িয়েছিল : সামাজিক দূরত্ব অবশ্যই টেকসই ও স্থায়ী হওয়া চাই। উদাহরণস্বরূপ এটি একটানা কয়েক মাস হতে পারে। একসঙ্গে অনেক মানুষের জীবন বাঁচাতে এ অতি প্রয়োজন। স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের যেসব শহরে তড়িঘড়ি করে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছিল সেসব শহরে নতুন করে সংক্রমণ ও মৃত্যু ভয়াবহরূপ নিয়েছিল। কারণ তখনও ভাইরাস সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়নি।
চার: মহামারীর মারাত্মক প্রভাব দেখেই মানুষ কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছিল : প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যমান বাস্তবতায় সামাজিক দূরত্ব কতদিন প্রয়োজন হতে পারে বা কতদিন ঘরবন্দি থাকবে মানুষ।
কারণ টানা সামাজিক দূরত্ব ও বিধিনিষেধের সঙ্গে অর্থনীতির ক্ষতি ও মানুষের আয়-রোজগারের বিষয়টি জড়িত। বিষয়টি নিয়ে সেই সময়ের বিশেষজ্ঞদেরও উদ্বেগ ছিল।
তারাও জানতেন, একটানা কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস বিধিনিষেধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়; কিন্তু মানুষ ঠিকই মাসের পর মাস সামাজিক দূরত্ব চালিয়ে গিয়েছিল।
এর প্রধান কারণ ২০০৭ সালের এক গবেষণায় উঠে এসেছে। সেটি হল, মানুষ ততদিনে মহামারীর ঝুঁকি নিয়ে সচেতন হয়ে উঠেছিল। তারা এর ভয়াবহতা দেখেছিল। চোখের সামনেই কারও বাবা-মা, কারও সন্তান-আত্মীয়স্বজন মারা গিয়েছিল।
পাঁচ: মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর নেতৃত্ব দরকার : স্প্যানিশ ফ্লুবিরোধী লড়াইয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সৎ, কার্যকর ও আন্তরিক নেতৃত্বের বিকল্প নেই।
সফলতা ও ব্যর্থতার মধ্যে এ ব্যাপারটিই বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইস ও ফিলাডেলফিয়ার মধ্যে তুলনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। গবেষকরা বলছেন, ১৯১৮ সালে ওই রাজ্যের কয়েকটি শহরে সৎ ও নিষ্ঠাবান নেতা ছিলেন।
ছিল ভালো স্বাস্থ্য কমিশনারও যারা শহরের মেয়র, স্কুল-কলেজের প্রধান এবং পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন। মহামারীর বিরুদ্ধে এসব শহরের সফলতাও ছিল ঈর্ষণীয় ও নজিরবিহীন।
আবার কয়েকটি শহরের নেতৃত্ব ছিল খুবই খারাপ, অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ। একে অপরের ওপর দোষারোপই ছিল তাদের প্রধান কাজ। যেমন পেনসিলভেনিয়ায় ফিলাডেলফিয়া ও পিটার্সবার্গের মেয়ররা সবসময় গভর্নরের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত ছিলেন। আবার গভর্নরের দ্বন্দ্ব ছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য কমিশনারের সঙ্গে।
সান নিউজ/ আরএইচ