নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ে এসে দেশের হাসপাতালগুলোতে চরম সংকট চলছে। আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি নিয়ে যেমন চলছে দৌড়াদৌড়ি ঠিক তেমনি ভর্তি রোগীরা পাচ্ছেন না ঠিকমত চিকিৎসা। যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন তার বেশিরভাগই অক্সিজেন বার আইসিইউয়ের অভাবে মারা যাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ঠরা জানিয়েছেন।
রোগীর স্বজনরা এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌড়াচ্ছেন শুধু একটি আইসিইউ বেড বা অক্সিজেন সাপোর্ট নেয়ার জন্য।
সূত্রমতে, গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্ত হওয়ার পর বাড়তে থাকে সংক্রমণ। জুন-জুলাইতে সংক্রমণ গতি ছিল ঊর্ধ্বমুখী। জুলাইতে সর্বোচ্চ ৬৪ জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু এ রেকর্ড ভেঙে গত বৃহস্পতিবার দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় মৃত্যু হয়েছে ৭৭ জনের। প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে সংক্রমণের রেকর্ড। গতকালও মারা গেছেন ৬৩ জন, আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৬২ জন। এ বিপুল পরিমাণ রোগীর চিকিৎসা দিতে হাসপাতালগুলোয় তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ সংকট।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হওয়ার তিন দিন পার না হতেই অনেক রোগীর শারীরিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফুসফুস। শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন রোগীরা। প্রয়োজন হচ্ছে হাই ফ্লো অক্সিজেন ও আইসিইউর। কিন্তু শয্যা সংকটে মিলছে না চিকিৎসা। এর মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক চিকিৎসক, নার্স দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে স্বল্প জনবল, স্বল্প শয্যায় বিপুলসংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতালগুলোকে।
কোভিড-ননকোভিড সব রোগীই পড়েছেন বিপাকে। সিএনজি কিংবা অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন রোগের কঠিন যন্ত্রণা নিয়ে। একটি সিটের জন্য তাদের কাতর অপেক্ষা।
গত রাতে একজন প্রবীণ সাংবাদিক ঢাকার চারটি হাসপাতাল ঘুরেছেন একটি বেডের জন্য। রাতভর পুরো ঢাকা শহর ঘুরে অবশেষে পঞ্চম হাসপাতালে গিয়ে মিলেছে একটি বেড। অনেক রোগীর কপালে তাও জুটছে না। হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতেই নিভে আসছে জীবনপ্রদীপ।
করোনা রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় এবং সংক্রমণের ভয়ে অন্য জটিল রোগীরাও সেবা পাচ্ছেন না। প্রয়োজনে মিলছে না আইসিইউ। তাই করোনা আক্রান্ত না হলেও অন্য রোগে সেবা না পেয়ে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের বড় সরকারি সাত হাসপাতাল এবং বেসরকারি সাত হাসপাতালের কোথাও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) শয্যা ফাঁকা নেই। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ১৬, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতলের ১০, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভারের ১৬, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৬, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৯, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ বেডের সব কটিতে রোগী ভর্তি রয়েছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০ বেডের আইসিইউতে রোগী ভর্তি আছেন ২১ জন। বেডের অতিরিক্ত রোগী ভর্তি সেখানে। কেবল নতুন স্থাপিত শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ফাঁকা রয়েছে মাত্র চারটি। সরকারি ১০ হাসপাতালের মোট ১৩২টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ফাঁকা রয়েছে মাত্র তিনটি, রোগী ভর্তি আছেন ১২৯ জন।
এত দিন বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আইসিইউতে কিছুটা ফাঁকা থাকলেও সেখানেও ফাঁকা বেডের সংখ্যা শুন্য হতে শুরু করেছে। আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২২, আসগর আলী হাসপাতালের ১৮, ইবনে সিনা হাসপাতালের ৭, ইউনাইটেড হাসপাতালের ১৫, ইম্পালস হাসপাতালের ৫২, এএমজেড হাসপাতালের ১০ ও বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ৯টি বেডের সব গুলোতে রোগী ভর্তি আছেন। কেবল স্কয়ার হাসপাতালের ১৯ বেডের মধ্যে চারটি এবং এভারকেয়ার হাসপাতালের ২১টির মধ্যে ১০টি বেড ফাঁকা রয়েছে। হাসপাতালগুলোর ১৭৩টি আইসিইউ বেডে রোগী ভর্তি আছেন ১৫৯ জন এবং বেড ফাঁকা রয়েছে মাত্র ১৪টি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকাভুক্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মোট ৩০৫টি আইসিইউ বেডে রোগী ভর্তি আছেন ২৮৮ জন এবং বেড ফাঁকা রয়েছে মাত্র ১৭টি। ঢাকা ছাড়া এত দিন দেশের অন্য হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ বেড ফাঁকা থাকলেও সেখানে রোগী ভর্তি হতে শুরু করেছে, কমতে শুরু করেছে ফাঁকা বেডের সংখ্যা। সারা দেশের অন্য হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ বেড রয়েছে ৬০০, তাতে রোগী ভর্তি আছেন ৪৪৫ জন এবং বেড ফাঁকা রয়েছে ১৫৫টি। গতকাল সারা দেশের করোনা রোগীদের জন্য শয্যা ছিল ৯ হাজার ৯৯২টি, আইসিইউ ছিল ৬০০। ঢাকার হাসপাতালে শয্যা ছিল ৩ হাজার ৬২২টি, আইসিইউ ছিল ৩০৫টি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা বলেন, এ বছরের মার্চে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় আমরা রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় আরও ১০০ আইসিইউ শয্যা সংযুক্ত করছি। এর মধ্যেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ১০টি করে আইসিইউ শয্যা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া মহাখালী ডিএনসিসি মার্কেট হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর কাজ চলছে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা বাড়ানো সমস্যা নয়, সমস্যা দক্ষ জনবলের। আইসিইউ ইউনিট চালানোর জন্য বিশেষ দক্ষ চিকিৎসক, নার্স ও ব্রাদার প্রয়োজন। আমাদের জনবলের সংকট এখনো রয়েছে।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনার সঙ্গে আমাদের লড়াই চলছে। গত বছরও হাসপাতালে আইসিইউ সংকট ছিল, এ বছরও আছে। ২৮টি জেলায় আইসিইউ আছে, ৩৬টি জেলায় নেই। এ জেলার রোগীরা বাঁচার আশায় ঢাকায় আসছেন। ঢাকায় তো সংক্রমণ বেশি, আগে থেকেই সংকট আছে। রোগীরা এত পথ পাড়ি দিয়ে এসে দেখছেন আইসিইউ নেই। আইসিইউ সংকটে, অক্সিজেনের অভাবে রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে, বাড়ছে মৃত্যু। সময় গেলেও আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি।
সাননিউজ/টিএস/