সান ডেস্ক:
পৃথিবীর আর কোন দেশই বাদ নেই নভেল করোনভাইরাসের ছোবল থেকে। দিন যত গাড়াচ্ছে, মানুষের মাঝে আতঙ্ক যত বাড়ছে, একই সঙ্গে এর থেকে বাঁচতে নানা ধরণের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে এ ধরণের বিভ্রান্তিমূলক নানা পরামর্শের অভাব নেই যেন। আর সেগুলোর কোনটির বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি। বিভ্রান্তিগুলো এতো বেশি ছড়াচ্ছে যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেসব ভ্রান্ত ধারণা সম্পর্কে সাবধান করছে মানুষকে।
গরম বেশি পড়লে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটে না:
অনেকের ধারণা, যে সব অঞ্চলের তাপমাত্রার উষ্ণতা বেশি সেখানে করোনাভাইরাসের বিস্তার কম হয়। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, মৌসুমি রোগের প্রাদুর্ভাবের ক্ষেত্রে সাধারনত যেমনটা ঘটে, মহামারির ক্ষেত্রে তা ঘটে না।
এটা প্রমানিত যে, বেশ কিছু সংক্রমণ রোগের প্রাদুর্ভাব ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়। অনেক ধরণের ইনফ্লুয়েঞ্জা শীতের মৌসুমে দেখা দিলেও গরম শুরু হলে চলে যায়। বিপরীতে টাইফয়েডের মতো অনেক রোগের মোক্ষম সময় আবার গরমকাল।
করোনাভাইরাসের সঙ্গে আবহাওয়ার সম্পর্ক নিয়ে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই ভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহ এবং আর্দ্রতার সম্পর্ক রয়েছে। আরেকটি গবেষণাযর ফল বলছে, উচ্চ তাপমাত্রা এটির বিস্তারে বাঁধার সৃষ্টি করে। তবে শুধুমাত্র তাপমাত্রা এই রোগের বিস্তারের ওপর প্রভাব ফেলে না।
তাই এসব গবেষণার ক্ষেত্রে কয়েক ঋতু পর্যবেক্ষণ করে শেষমেষ কম্পিউটার মডেলিংয়ের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে গবেষকদের।
''মানব শরীরের বাইরে ভাইরাসের বিস্তারে জলবায়ু অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ভাইরাস যতক্ষণ মুক্ত আবহাওয়ায় টিকে থাকবে, ততক্ষণ সেটা অন্যদের সংক্রমিত করবে। সেক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের বিস্তার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মূলত ঠাণ্ডা এবং শুষ্ক আবহাওয়ায় এই ভাইরাসের বিস্তার বেশি হয়েছে।''
স্পেনের ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল সায়েন্স ইন মাদ্রিদের গবেষক মিগুয়েল আরাজো এমন কথা বলার পাশাপাশি এও বলছেন যে, এ ক্ষেত্রে মানুষের আচরণও অনেক ক্ষেত্রে ভুমিকা রাখবে। তাই সবক্ষেত্রে একই রকম দেখা যাবে না। কারণ প্রধানত একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে এই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। ফলে মানুষ যত বেশি মেলামেশা করবে, সেখানে সংক্রমণের হারও বেশি হবে। ''
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, কোভিড-১৯ যেহেতু নতুন একটি ভাইরাস, তাই আবহাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলার সময় এখনও আসেনি। নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, গরম এবং স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় করোনা বাঁচেনা । বরং এখন পর্যন্ত যে ধরণের তথ্য-প্রমাণ বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন, তাতে যে কোনো আবহাওয়াতেই, যে কোন স্থানেই কোভিড-১৯ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।
‘সুতরাং গরম পড়লেও সবার উচিৎ সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করা’। এমনটা উল্লেখ করে ডাব্লিউএইচও তাই বলছে, মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে, বারবার হাত ধুতে হবে।
ভারী বরফে করোনার টিকতে না পারা:
এদিকে শীত প্রধান দেশের মানুষেরা আবার ভাবছিলেন যে, ভারী বরফ পড়লে হয়তো করোনাভাইরাস আর টিকতে পারবে না। সেই ধারণাও ভুল। গবেষকরা বলছেন, বরফ যত বেশিই পড়ুক কিংবা বাইরের তাপমাত্রা যত বেশিই হোক না কেন মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা সাড়ে ৩৬ ডিগ্রি থেকে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সুতরাং করোনাভাইরাস বরফে ঢাকা পড়ে বিদায় নেবে, এমন ধারণাও বিভ্রান্তিকর।
ভেষজ ও অন্যান্য বিকল্প ওষুধ:
নতুন এই ভাইরাসের চিকিৎসায় অনেকে অনেক ধরণের ভেষজ ওষুধের পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে ভাইরাসটির চিকিৎসায় নির্দিষ্ট কোনো ওষুধের বিষয়ে সুপারিশ করা হয়নি এখনও।
তবে সংস্থাটির মতে, করোনাভাইরাসের লক্ষণ দেখা দিলে তার চিকিৎসায় যথাযথ যত্ন নেওয়া উচিত। আর মারাত্মক অসুস্থ রোগীদের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
রসুনে সংক্রমণের ঝুঁকি কম:
ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে যে, করোনা ঠেকাতে রসুন খাওয়া অনেক বেশি কার্যকর। এক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য হল- এটিও একটি বিভ্রান্তিকর ধারণা। রসুন স্বাস্থ্যকর একটি খাবার এবং এতে জীবাণুনাশক কিছু উপাদান রয়েছে, এটি ঠিক। কিন্তু রসুনে কোভিড-১৯ দূর করবে, এমন ধারণার বৈজ্ঞানিক কোন প্রমাণ মেলেনি এখনও।
পূর্ব অসুস্থতা না থাকলে করোনার ঝুঁকি নেই:
প্রথম দিকে এমনটাই শোনা যাচ্ছিল যে, আগে থেকেই জটিল রোগাক্রান্ত মানুষের ক্ষেত্রেই কেবল করোনাভাইরাসের ঝুঁকি বেশি। কিন্তু সেই ধারণাও ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছে ভাইরাসটির চরিত্র। ফ্রান্সে গত ২৬ মার্চ ১৬ বছরের এক তরুণী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। প্যারিসের মৃত ওই তরুণীর নাম জুলিয়া। তিনি আগে থেকে অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত ছিলেন না বলে গণমাধ্যমকে জানান তার মা। এমন আরও উদাহরণ রয়েছে বিশ্ব জুড়ে। তবে এটা ঠিক যে, এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ বা ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি।
কমবয়সীরা নিরাপদ :
প্রথম দিকে এটিও বলা হচ্ছিল যে, বয়স্ক মানুষদের জন্যই এই ভাইরাসে আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি। এই ধারণাও যে ভুল, তা প্রমানিত হয়েছে এরই মধ্যে। খোদ বাংলাদেশেই যে কজন করোনারোগী শনাক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে কম বয়ীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এমকি সদ্য জন্ম নেয়া শিশুও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার খবর এরই মধ্যে জেনেছেন সবাই। তাই যে কোনো বয়সের মানুষই নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন।
কোভিড-১৯ ঠেকাতে নিউমোনিয়ার টিকা :
বেশ কিছুদিন এমন ধারণা মানুষের মনে দেৃঢ়ভাবে কাজ করছিল যে, নিউমোনিয়ার টিকা করোনাভাইরাসের সংক্রমন থেকে বাঁচা যাবে। তবে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এই মুহুর্তে বাজারে যে ধরণের নিউমোনিয়ার টিকা রয়েছে, সেগুলো নতুন এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করেনা।
আ্যন্টিবায়েটিক দিয়ে করোনার চিকিৎসা:
অ্যান্টিবায়োটিক কোনো ভাইরাসের ক্ষেত্রেই কাজ করে না বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। কোভিড-১৯’ও একটি ভাইরাস। এটির চিকিৎসাযতেও তাই অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কোনভাবেই ঠিক নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে তারা বলছেন যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে কেউ যদি কোনো ব্যাকটেরিয়াতেও আক্রান্ত হন, তবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে।
মশার কামড়ে করোনাভাইরাস ছড়ায় না:
মশার কামড়ে করোনাভাইরাস ছড়ায় কি না, তা নিয়েও চলেছে অনেক ধরণের জল্পনা-কল্পনা। তবে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের হাতে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি যে, মশার কামড়ের মাধ্যমে নেভেল করোনাভাইরাস একজনের দেহ থেকে অন্যের দেহে যেতে পারে।
শরীরে অ্যালকোহল ছিটিয়ে বাঁচা যায়:
এটিও একটি ভ্রান্ত ধারণা বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, ভাইরাসটি যদি একবার শরীরে ঢুকে পড়ে, তবে সেই শরীরে আর অ্যালকোহল বা ক্লোরিন ছিটিয়ে কোনো লাভ নেই। এতে বরং চোখ বা মুখের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
গরম পানিতে গোসল:
অনেকের ধারণা গরম পানিতে গোসল করলেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু বেশি গরম পানিতে গোসল করলে হিতে বিপরীতটাই বরং ঘটার সম্ভাবনা বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
লবণ-পানি দিয়ে নাক ধোওয়া:
লবণ মেশানো পানি দিয়ে নিয়মিত নাক পরিস্কার করলে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ থেকে বাঁচা যায়, এমন কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণও এখনো মেলেনি।