নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশজুড়ে সাগর-নদীতে মিলছে প্রচুর ইলিশ, সরবরাহ বেড়েছে অবিশ্বাস্য হারে, ফলে কমেছে দাম। ভরা মৌসুমের মেয়াদ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় জেলে ও ইলিশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরও কিছুদিন ইলিশ পাওয়া যেতে পারে।
এদিকে আগের তুলনায় বড় সাইজের ইলিশ বেশি পাওয়া যাচ্ছে। সরবরাহ বাড়ায় দামও গতবারের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
বাংলা ভাদ্র মাসের শেষের দিকে বরিশাল, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ভোলা, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, শরীয়তপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জেলেরা বলছেন, অন্য বছরগুলোর চেয়ে এবার জালে ইলিশ উঠছে বেশি।
মৎস্য বিশেষজ্ঞ, জেলাগুলোর মৎস্য কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রচলিত ভরা মৌসুম পেরিয়ে অক্টোবরের শেষেও মিলতে পারে প্রচুর ইলিশ।
বরিশালের পোর্টরোডের বেসরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের আড়তদাররা বলছেন, মৌসুমের শুরুতে বৈশাখ মাসের দিকে তেমন ইলিশের দেখা মেলেনি। তবে এখন মৌসুমের মাঝামাঝি বা ভরা মৌসুমে ইলিশের আমদানি অবিশ্বাস্যভাবে বেড়েছে।
ফলে দাম কমেছে জাতীয় মাছের উল্লেখ করে ওই কেন্দ্রের আড়তদার মো. নাসির উদ্দিন জানান, প্রতিমণ ইলিশ দেড় কেজি সাইজের ৩৬ হাজার টাকা, এক কেজি ২০০ গ্রাম সাইজের ৩০-৩২ হাজার টাকা, এক কেজি সাইজের ২৭-২৮ হাজার টাকা, রপ্তানিযোগ্য এলসি সাইজ (৬০০ থেকে ৯০০ গ্রাম) ২০-২২ হাজার টাকা, ভেলকা (৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম) সাইজ ১৪-১৫ হাজার টাকা এবং গোটলা সাইজ বিক্রি হচ্ছে ৯-১০ হাজার টাকা দরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত মৌসুমে এ সময়ে ৮০০ থেকে এক হাজার মণ মাছ এসেছে বরিশালের বেসরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে। আবার কয়েকদিন আগেও এ মোকামটি ছিল ইলিশশূন্য। এখন সেই মোকামেই প্রতিদিন আসছে দেড় থেকে দুই হাজার মণ ইলিশ। আবার অনেক দিন তো তিন থেকে চার হাজার মণ সাগরের ইলিশেরও দেখা মিলছে।
বরিশাল পোর্টরোডের আড়তদার মো. জহির সিকদার জানান, শনিবার (০৫ সেপ্টেম্বর) মোকামে অন্তত চার হাজার মণ ইলিশ এসেছে। এর বেশিরভাগ সাগরের। একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ ইলিশ আসায় কমেছে মাছের দাম। করোনাকাল আর আমদানি বেশি হওয়ায় গত বছরের চেয়ে বর্তমান সময়ে প্রায় অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, চলতি মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। জেলেরা বেশ খুশি, তাদের জালে ধরা পড়ছে বেশ বড় সাইজের ইলিশ।
তিনি আরও বলেন, গত বছর লক্ষ্মীপুর জেলায় ২০ হাজার মেট্রিকটন ইলিশ ধরা হয়েছিল। এবার আশা করা হচ্ছে, তা ২৫ হাজার মেট্রিকটন ছাড়িয়ে যাবে।
এই মৎস্য কর্মকর্তা মনে করেন, জাটকা শিকার, মা ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ও সমুদ্রে ৬৫ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধসহ সরকারের নানা পদক্ষেপে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে।
বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, টানা ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা, একমাস সাগর উত্তাল থাকায় জেলেরা মাছ ধরতে না পারা- সবমিলিয়ে এবারে মাছের উৎপাদন ভালো এবং সাইজও বড়। যে মাছ ৬০০ গ্রামে ধরা হতো, এখন তা ধরা হচ্ছে এক কেজির ওপরে।
তিনি বলেন, গত বছর বরিশাল জেলায় প্রায় ৪১ হাজার মেট্রিকটন ইলিশ ধরা পড়েছে। এবার তা ছাড়িয়ে ৫০ হাজার মেট্রিকটন হতে পারে।
হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপের ইলিশ মোকাম মালিক কেফায়েত উল্লাহ বলেন, গত কিছুদিন মেঘনায় বেশ বড় সাইজের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পরিবেশ পরিস্থিতি ঠিক থাকলে আরও কিছুদিন জালে ইলিশ আসবে।
তবে অভ্যন্তরীণ নদীর ইলিশের আমদানি কম থাকায় সেগুলোর দাম এখনও কিছুটা বেশি। যদিও কয়েকদিন পরে নদীতেও প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাবে এবং এর ধারাবাহিকতা ডিমওয়ালা ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার আগ পর্যন্ত থাকবে বলে জানিয়েছেন মৎস্য দপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আনিছুর রহমান।
বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাসও জানান, এখন ইলিশের ভরা মৌসুম চলছে। যদিও এর আগে গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রে ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল। নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও বৈরি আবহাওয়ার কারণে জেলেরা ১৭ থেকে ১৮ দিন সমুদ্রে যেতে পারেননি। এই সময়ের মধ্যে ইলিশ অনেক বড় হয়েছে। এর মধ্যে ইলিশ ধরার দুটি জো ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় দুটি জোতেই ইলিশ শিকার হয়নি। এখন জেলেরা ইলিশ শিকার করতে যাচ্ছেন। এজন্য সব ইলিশ একসঙ্গে ধরা পড়ছে। তাই মোকামগুলোতে ইলিশের আমদানি বেড়েছে। কমেছে সাগরের ইলিশের দামও। তবে নদীর ইলিশ এখনও উঠতে শুরু করেনি। নদীর ইলিশের দামও বেশি। কিছুদিনের মধ্যে নদীর ইলিশের আমদানিও বেড়ে যাবে বলে আশাবাদী তিনি।
মৎস্য গবেষকরা আরো বলছেন, মে-জুন মাসে সাগরে সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকে। মা ইলিশ রক্ষায় নিষেধাজ্ঞা আসে অক্টোবরে। দুই নিষেধাজ্ঞার মধ্যবর্তী সময়টা ইলিশের ভরা মৌসুম। এই সময়ে সাগর ও নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে, আবার আকৃতিও বড়। কিন্তু এখন ইলিশের ভরা মৌসুমের পরিবর্তন খুব স্পষ্ট। ইলিশের প্রজনন ও বিচরণের সঙ্গে বৃষ্টির সম্পর্ক রয়েছে। বৃষ্টির মৌসুমে হেরফের হওয়ায় ইলিশের ভরা মৌসুমও সরে এসেছে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে।
ইলিশের প্রচলিত ভরা মৌসুম জুন থেকে আগস্ট। কিন্তু সেপ্টেম্বরে এসেও সাগর-নদীতে ঝিলিক দিচ্ছে রুপালি ইলিশ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ফেনী ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. মো. সাইফুদ্দিন শাহ্ বলেন, আশার খবর হলো, এ বছর ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। সরকার মৎস্য ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণ কাজে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞারোপ করেছে। দেশের মোহনা অঞ্চলের নদীগুলোতে বিজ্ঞানভিত্তিক অ্যাডাপ্টিভ কো-ম্যানেজমেন্ট এবং জেলেদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক-প্রতিবেশিক সক্ষমতা বাড়ার উদ্দেশে চলমান ইকোফিশ প্রকল্পে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ এবং পরে জাটকা ধরায় নিষেধাজ্ঞারোপে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, ইলিশের মৌসুমেও আসছে পরিবর্তন। এর কারণ হচ্ছে বৃষ্টির সময়কাল, বৈশ্বিক জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলে এমনটা হচ্ছে বলেও তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্ব) ড. মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘ইলিশের উৎপাদন আমরা আশা করছি, এ বছর বেশি থাকবে। এর কারণ হচ্ছে যে, এটি নির্ভর করে বৃষ্টিপাতও পানির গুণাগুণের ওপরে। করোনার কারণে অনেক কিছু বিপরীত দিকে গেলেও পানি ও নদীদূষণ কিছুটা কম হয়েছে, নদীতে যান চলাচল কিছুটা কম করেছে, যে কারণে পানির গুণাগুণ ভালো আছে। ফলে পানিতে মাছের ভালো খাবারও আছে।’
‘এ বছর একটু আগে থেকেই ইলিশ আসা শুরু করেছে। এবারের মাছের আকারও বেশ বড় ছিল। আমাদের গবেষণা বলছে, এবারের মাছের উৎপাদন আগের বছরগুলোর চেয়ে ভালো থাকবে।’
তিনি বলেন, ইলিশের মৌসুমতো সাধারণত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হয়ে থাকে। অক্টোবরের ২২ দিন নিষিদ্ধ থাকতে পারে। তবে এবার অক্টোবরে দুটি অমাবস্যা-পূর্ণিমা আছে একটি অক্টোবরের শুরুর দিকে (২ অক্টোবর) আরেকটি আছে অক্টোবরের শেষের দিকে (৩১ অক্টোবর)। আমরা আশা করছি, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের আলোকে অক্টোবরের শেষের দিকেই প্রজনন মৌসুমের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা আসবে।
তবে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় জেলে-ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা খুশি হলেও দর কমায় ক্ষতির শঙ্কাও রয়েছে তাদের। চলতি মৌসুমে ইলিশের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার এই সুবিধা এখনও মিলছে না খুচরা বাজারের ভোক্তা পর্যায়ে। অন্যদিকে রপ্তানির সুবিধা থাকলেও মোকামে আমদানি হওয়া ইলিশ সংরক্ষণে বেগ পেতে হত না বলে দাবি ব্যবসায়ীদের।
তাদের মতে, শুধু সাগরের ইলিশেই এখন চাহিদার ওপরে আমদানি ঘটছে। আবার করোনার প্রভাবে দেশের বাজারে ও সাধারণ ক্রেতাদের কাছে মাছের চাহিদা অনেকটাই কমে গেছে। সেক্ষেত্রে এ পরিস্থিতিতে আমদানি দ্বিগুণ হওয়ায় পচন, লোকসান হওয়াসহ নানা শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সাম্প্রতিককালে এতো কম দামে পাইকারি বাজারে ইলিশ বিক্রি না হলেও খুচরো বাজারে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না বলে দাবি ক্রেতা হাবিবুর রহমানের।
আবার এতো মাছের আমদানিতেও খুব একটা খুশি হতে পারছেন না জেলেরা। কারণ, অক্টোবরের নিষেধাজ্ঞা শুরুর বেশি দিন বাকি নেই। আর মোকাম মালিকরা বলছেন, রপ্তানি বন্ধ থাকার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে মাছ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই বাজারে চাহিদার বেশি মাছ এলে তা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
জেলে ও আড়তদারদের লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে অন্তত ভরা মৌসুমে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
যদিও রপ্তানির অনুমতির বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ মহলের হাতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (হিলসা) বিমল চন্দ্র দাস।
বরিশাল জেলা মৎস্য আড়তদার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল বলেন, এতো পরিমাণ ইলিশ আসছে, রাখার জায়গা নেই। সংরক্ষণের জন্যও নেই কোনো হিমাগার। এ কারণে কম দামে ছেড়ে দিতে হচ্ছে ইলিশ।
মাছ ব্যবসায়ী মাসুম জানান, হিমাগার না থাকায় সংরক্ষণের অভাব। গত এক সপ্তাহ ধরে সাগরের ইলিশই বেশি আসছে। দিন যতো সামনে এগোবে, ততো বেশি মাছ ধরা পড়বে। কিন্তু সংরক্ষণ না করা গেলে আমদানি বাড়তে থাকলে ধারাবাহিক দরপতনে লোকসানে পড়বেন জেলে ও ব্যবসায়ীরা।
হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপের ইলিশ মোকাম মালিক কেফায়েত উল্লাহও মনে করছেন, ইলিশের ভরা মৌসুম পিছিয়ে যাচ্ছে। আর সে কারণে নিষেধাজ্ঞার সময়ও পেছানো দরকার।
সান নিউজ/ এআর