নিজস্ব প্রতিবেদক:
বরিশাল ও ভোলা: বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ভোলাসহ উপকূলীয় এলাকাকে রক্ষায় বাঁধের উচ্চতা বাড়াতে সমীক্ষা চলছে। সমীক্ষা শেষে হলে বাঁধের উচ্চতা চার মিটার বা ১২ ফুট থেকে বাড়িয়ে ছয় মিটার ১৮ ফুট করা হবে বলে জানিয়েছেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম।
শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) ভোলা সদরের ইলিশাসহ দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন ও চরফ্যাসন উপজেলায় চলমান বাঁধ নির্মাণ কাজের অগ্রগতি পরিদর্শন ও নদী ভাঙন কবলিত এলাকা ঘুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা বলেন তিনি।
জাহিদ ফারুক শামীম সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন না করে, জনগণকে ভয় না দেখিয়ে, ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করুন। এতে আমাদের কাজ করতে সুবিধা হবে। যারা রাত-দিন কাজ করেন, তারা উৎসাহিত হবেন, এ দায়িত্ব আপনাদের।’
‘আমাদের প্রকৌশলীরা পরিবার-পরিজন রেখে করোনার মধ্যেও রাত-দিন দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করেছেন। আপনারা উৎসাহ না দিলে তারা কাজ করবেন কিভাবে? এ দেশটা আমাদের বঙ্গব্ন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার যে লক্ষ্য, সেখানে পৌঁছাতে হলে আমাদের যে রকম দরকার, আপনাদেরও সে রকম দরকার। আপনারা যতো ভালো সংবাদ পরিবেশন করবেন, ততোই প্রকৌশলীরা উৎসাহিত হবেন। আমাদের সহযোগিতা করুন, সঠিক তথ্য দিন।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমরাও কাজ করে যাচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। একেক বছরে একেক ধরনের আবহওায়া দেখছি। কোনো বছরে বন্যা, কোনো বছরে ঘূর্ণিঝড় বেশি হচ্ছে।’
‘পুরো ভোলাই দ্বীপের ভেতরে, চারদিকে নদী ও সমুদ্র বেষ্টিত। ভোলার উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ভোলায় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনেক প্রকল্প রয়েছে। ভোলা শহরকে রক্ষার জন্য ইলিশা এলাকার ৩৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্লক বাঁধের কাজ চলছে। শিবপুর এলাকায় আরও একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব চলমান প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভোলা সদরকে সুরক্ষিত করতে পারবো। আজ আমরা যে জায়গা পরিদর্শন করেছি, সেখানে কিছু ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে প্রকৌশলীদের।’
তিনি বলেন, ‘গত আম্ফানে সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেখানে ৮৯৬ কোটি টাকা, এক হাজার ৫২ কোটি টাকা ও ১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে তিনটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে সেগুলো পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আর পোল্ডার-৫ এ তিন হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকার বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্প রয়েছে, যেটা চলছে।’
‘এখানে ১৩৯টি পোল্ডার রয়েছে, যার মধ্যে ১৭ টি পোল্ডারে হাত দেওয়ার পরিকল্পনা আমরা করেছিলাম। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় আপাতত ১০টি পোল্ডারের কাজ আমরা করছি। এর বাইরে বিশ্বব্যাংকের সাহায্য নিয়ে বাদ দেওয়া সাতটিসহ আরো ২২টি নিয়ে মোট ২৯ টি প্লোডারের জন্য আর একটি প্রকল্পের সমীক্ষা করা হচ্ছে। বাকিগুলোর কাজও পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে করা হবে।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। আজ নদীর তীর রক্ষায় বাধ নির্মাণের কথা বললাম, কাল কাজ শুরু করে দিলাম, তাহলে তা টিকবে না। কারণ, এক এক নদীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একেক রকম। যা আমাদের টেকনিক্যাল টিম এসে পর্যবেক্ষণ করেন। আবার পরীক্ষাকালে একবার দেখে গেলেও হবে না। কারণ, বর্ষা মৌসুমে নদীর চরিত্র একরকম, শুকনো মৌসুমে আবার আরেক রকম। একটা সমীক্ষা করে প্রকল্প করতে এক থেকে দেড় বছর সময় লাগে। কিন্তু আমরা তাড়াহুড়া করে সংসদ সদস্যদের চাহিদার ওপর টিকতে না পেরে ছয়মাসে করি।’
‘পরে দেখা যায়, ভুল হলে আপনারা বলেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় চুরি করেছে। কিন্তু পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের সক্ষমতা, কার্যক্ষমতা অনেক বাড়িয়েছে, তারা রাত-দিন কাজ করছে। আমরাও রাত-দিন কাজ করছি। কোথাও ভাঙলে পরে সে খবর তাৎক্ষণিকভাবে আমরা অনলাইনে (হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ) পাচ্ছি। সেখানে কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব ছবি ও তথ্য আমরা পাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘ঘনবসতিপূর্ণ আমাদের দেশে বাঁধের ওপরও মানুষ বসবাস করেন। সেখানে ঘর-বাড়ি করেন, রান্না-বান্না করেন। সেখানে ইঁদুরের বাসা হয়, নিচ থেকে ইঁদুর গর্ত করে। তখন বাঁধ দেখে ওপর থেকে মনে হয়, ঠিক আছে। কিন্তু নিচ থেকে ইঁদুরের করা গর্তের কারণে বাঁধটি হঠাৎ করে ধসে গেছে। তাই বাঁধের ওপর বসবাস করাটাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে।’
জাহিদ ফারুক শামীম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ডেল্টা প্লান অনুসারে আমরা ৬৪ জেলায় খাল খনন করছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে বড় নদীগুলোকে ছোট করে নিয়ে আসবো, অর্থাৎ প্রস্থে ৯-১২ কিলোমিটারের নদীগুলোকে ৫ থেকে ৭ কিলোমিটারে নিয়ে আসবো। ড্রেজিং করে মাটিটাকে রিক্লেইম করে যে এলাকা বাড়াবো, সেটাকে ফসলের জন্য রাখবো, বসতির জন্য নয়। ফ্লাটপ্লেইনের বাইরে আমরা বাঁধ দেবো এবং বনায়ন করবো। আম্ফানে দেখেছি, যেখানে নদীর তীর গাছ ছিলো, সেখানে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। যেখানে গাছ ছিলো না, সেখানে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, উপকূলে বয়ে যাওয়া ফনী, আম্পানসহ বিভিন্ন ঝড়ের সময় বাঁধের ওপর দিয়ে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ভোলাসহ উপকূলীয় এলাকাকে রক্ষায় বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। যা খুব শিগগিরই বাস্তবায়িত হবে।
‘উপকূলীয় এলাকায় আগের বাঁধগুলো ৬০-৮০ দশকের নিয়মে তৈরি। তখন চার মিটার বা ১২ ফিট উচ্চতা ছিলো। এরপর আইলা, ফনি, বুলবুল, আম্পানের সময় আমরা দেখেছি, জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। তখন বাঁধের ওপর দিয়ে পানি যেতে দেখেছি। এখন প্রকল্পগুলো রিভাইজ করা হচ্ছে। বাঁধের উচ্চতা বাড়াতে সমীক্ষা চলছে, যা শেষ হলে উচ্চতা বাড়িয়ে ছয় মিটার অর্থাৎ ১৮ ফুট করা হবে। নতুন যেগুলো করা হচ্ছে, সেগুলোর উচ্চতা বাড়ানো হচ্ছে, আগেরগুলো নিয়েও পরিকল্পনা রয়েছে।’
পরিদর্শনকালে প্রতিমন্ত্রী বিভিন্ন স্পটে পথসভায় বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করেছি বলেই আজ আমরা সাবলম্বী হওয়ার পথে যাচ্ছি। ফলে বড় বড় প্রকল্প হাতে নিতে পারছি। অতীতে কোনো সরকার এতো বড় বড় প্রকল্প করতে পারেনি। সকলে মিলে কাজ করলে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।’
ভোলা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুল, ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, ভোলা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদুর রহমানসহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন।
সান নিউজ/ এআর