হারুন উর রশিদ সোহেল, রংপুর থেকে:
করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া যুবক-তরুণরা মাঠে নেমেছেন ভিন্ন পেশায় আত্মনির্ভরশীল হতে। অনেকে আগের পেশা বদল করে ভাগ্যজয়ের স্বপ্ন দেখছেন। লাভজনক হওয়ায় তাই রংপুরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মেশিনে (ইনকিউবেটর) ডিম ফুটিয়ে হাঁস-মুরগি পালন।
বদরগঞ্জ উপজেলায় স্থানীয়ভাবে ওই মেশিনের কারিগর রাশেদুল হক আকন্দ। আগে মৌসুমি ব্যবসায়ী হিসেবে নানা পণ্যের ব্যবসা করে জীবন-জীবিকা চালাতেন
এই যুবক। কিন্তু করোনার কারণে হাট-বাজার ও যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় ওই ব্যবসার পরিসর সীমিত হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে এখন ডিম ফুটানোর মেশিন তৈরি করে নিজের আয়-রোজগারের পথ খুঁজে পেয়েছেন।
রাশেদুলের দেশি প্রযুক্তিতে তৈরি ইনকিউবেটরের খবর পেয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে মেশিন তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা। হাতের নাগালে ইনকিউবেটর পাওয়ায় উপজেলার পৌরশহরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে এভাবে খুব দ্রুতই গড়ে উঠেছে হাঁস-মুরগি পালনের শতাধিক খামার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পৌর শহরের শাহাপুর এলাকায় গড়ে উঠেছে হাঁস-মুরগি পালনের দু’টি খামার। আবুল কাশেম ব্রয়লার মুরগির মাংস ব্যবসায়ী ছিলেন। করোনা ক্রান্তিকালে তার ওই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। তাই নিজ বাড়িতে একসঙ্গে ১০ হাজার ডিম ফুটানোর মেশিন বসিয়েছেন।
একই এলাকার এনামুল হক আগে থেকেই হাঁস-মুরগি পালন করতেন। হাট-বাজারে সেসব বিক্রি করতেন। মুরগি ব্যবসায়ীরা তার কাছ থেকে কিনে নিয়ে যেতেন। কিন্তু করোনার কারণে হাট-বাজার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যবসায় মন্দা চলছে। তাই তিনিও নিজ বাড়িতে বসিয়েছেন এক সঙ্গে ৫ হাজার ডিম ফোটানোর মেশিন।
রাধানগর ইউনিয়নের লালদীঘি এলাকার যুবক হাবিব ও রিপন, কালুপাড়া ইউনিয়নের স্বাধীন, দামোদরপুর ইউনিয়নের আসমতপাড়ার মেনহাজুল, রামনাথপুর ইউনিয়নের ঝাকুয়াপাড়া এলাকার পীর মামুনসহ উপজেলার আরও অন্তত ১৫ জন যুবক শুরু করেছেন একই কাজ। তারা আগে কেউ ঢাকায় চাকরি করতেন। কেউ আবার স্থানীয়ভাবে ব্যবসা করতেন। এখন করোনার প্রভাবে চাকরির চলে যাওয়ায় এবং হাট-বাজারে ব্যবসার চাহিদা কমে যাওয়ায় তারা এখন নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে হাঁস-মুরগির ডিম ফুটানোর কাজ শুরু করেছেন।
ওই খামারিরাও খামারগুলো গড়েছেন রাশেদুল হকের কাছ থেকে ডিম ফুটানোর মেশিন সংগ্রহ করে।
আবুল কাশেম বলেন, ‘লকডাউনে আমার আগের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে আমার আয়ের পথও বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি এই কাজ শুরু করি। এটি অবশ্যই লাভজনক। তবে শ্রম দিতে হবে। যত্নশীল হতে হবে।’
এনামুল হক বলেন, ‘আমি পাঁচ হাজার ডিম ফুটানোর মেশিন বসিয়েছি। হাঁস, মুরগি ও কোয়েল পাখির ডিম ফুটাচ্ছি। এখানে ফুটানো হাঁসের বাচ্চা দিয়েই আমি আমার হাঁসের খামার করেছি।’
ইনকিউবেটর মেশিনের উদ্ভাবক রাশেদুল হক আকন্দ বলেন, ‘নানা ধরনের মৌসুমি কৃষিজাত ফসলের ব্যবসা করতাম আগে। করোনার জন্য তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কবুতর পালনের শখ থেকে কবুতরের ডিম সংগ্রহ এবং ডিম ফুটানোর মেশিন বানিয়েছিলাম প্রথমে। তারপর কবুতরের ডিমের সঙ্গে যুক্ত হয়, হাঁস, মুরগি ও কোয়েল পাখির ডিম। এখন নিজে সফল হওয়ার পাশাপাশি আমার বানানো মেশিনে ডিম ফুটিয়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে অনেক যুবকের। খুব সহজে ও কম খরচে হাঁস, মুরগি বা কোয়েল পাখির বাচ্চা ফুটিয়ে পালন করে বেশি লাভবান হচ্ছেন খামারিরা।’
রাশেদুল জানান, ইনকিউবেটর মেশিনে ডিম ফুটানোর ধাপ দু’টি। প্রথম ধাপের নাম ‘সেটার’ এবং অন্যটি ‘হ্যাচার’। মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফুটাতে সময় লাগে ২১ দিন। এর মধ্যে সেটারে রাখতে হয় ১৮ দিন এবং হ্যাচারে রাখতে হয় তিনদিন। হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটাতে সময় লাগে ২৮ দিন। এটিকেও হ্যাচারে রাখতে হয় তিনদিন আর সেটারে রাখতে হয় ২৫ দিন। কোয়েল ও কবুতরের ডিম থেকে বাচ্চা বের হতে সময় লাগে ১৭ দিন। হ্যাচারে রাখতে হয় তিনদিন, সেটারে রাখতে হয় ১৪ দিন। সেটারে যখন ডিম থাকে, তখন মাঝে মাঝে ডিম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দিতে হয়। মোরগের সঙ্গে ক্রস করিয়ে লেয়ার মুরগির ডিম থেকেও বাচ্চা সংগ্রহ সম্ভব বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, হ্যাচার থেকে বাচ্চা বের করার পর ব্রুডারে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রায় রাখতে হয় গ্রীষ্মকালে পাঁচ থেকে সাতদিন, আর শীতকালে ১৫ দিন। বিশেষ করে হাঁসের বাচ্চার বয়স একমাস না হওয়া পর্যন্ত পানিতে ছেড়ে না দেয়াই ভালো।
বদরগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ওমর ফারুক বলেন, বদরগঞ্জে এই হ্যাচিংটা ছিল না। আগে হাতেগোনা মাত্র ১০/১২টি খামার ছিল। খামারিরা সবাই বাচ্চা নিয়ে আসতেন বাইরে থেকে। যেহেতু এখন ইনকিউবেটর মেশিন স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে তাই খামারের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে করোনাকালে গত চারমাসে ক্রমাগত বাড়ছে। ইতোমধ্যে হাঁসের খামার হয়ে গেছে শতাধিক। তাই বলা যায়, খামারে ইতিবাচক বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে বদরগঞ্জে। বাইরে থেকে বাচ্চা নিয়ে আসতে হচ্ছে না। তাই খামারিরা বেশি লাভবান হবেন।’
সান নিউজ/ এআর