বনিক কুমার, গোপালগঞ্জ থেকে:
কৃষকদের দিয়ে ফলদ ও বনজ সম্পদ বাড়াতে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক বাগান করেছে। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে সৌন্দর্য বর্ধনে সরবরাহ করেছে বিভিন্ন জাতের ফুল ও পাতাবাহারের গাছ। গোপালগঞ্জসহ আশেপাশের জেলার কৃষক পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত মূল্যে ফুল-ফলের চারা বিক্রির ৩০ লাখ ২৫ হাজার টাকা জমা করেছে সরকারের রাজস্ব খাতে।
এভাবেই লোকবল সংকটেও মাত্র ছয় বছরে কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী হর্টিকালচার সেন্টার। ২০১৪ সালে উপজেলার রাতৈল এলাকায় ১৬ একর ৬২ শতাংশ জমিতে সেন্টারটি গড়ে তোলে কৃষি বিভাগ। সেখানে এখন উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ২০০ প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফল ও ফুলের চারা।
সেন্টারের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আমিনুল ইসলাম জানান, স্থাপনের পর থেকে এ পর্যন্ত নারকেল, আম, পেয়ারা, কাশ্মিরি কুল, বলসুন্দরী কুল, সিডলেস কুল, সিডলেস লেবু ও ড্রাগনসহ বিভিন্ন ফলের বাগান তৈরিতে জেলার দুই হাজার ৭০ জন কৃষককে বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। উপজেলাগুলোতে ৫৫টি ফলের বাগান প্রতিষ্ঠায় কৃষককে প্রশিক্ষণ, চারা বিতরণ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ এবং সার্বিক তদারকি করা হচ্ছে। অনেক কৃষক বাগান করে এখন লাভবান। আরও অনেকেই বাগান করতে আগ্রহী, সেন্টারে বা ওইসব চাষিদের কাছে এসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তারাও।
তিনি বলেন, হর্টিকালচারের প্রধান কাজ হচ্ছে, সেন্টারে মাতৃগাছ তৈরি করা। ইতোমধ্যে তৈরি দেশি-বিদেশি এক হাজারের বেশি মাতৃগাছের বীজ থেকে প্রতিনিয়ত চারা এবং কলমের মাধ্যমে নতুন নতুন গাছ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ফলের চারা উৎপাদনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ও পারিবারিকভাবে ফলের বাগান তৈরিতেও উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
এসব বাগানে রয়েছে অনেক মূল্যবান ওষুধি, দুস্প্রাপ্য, উন্নত পুষ্টি সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় ফলের মাতৃগাছ। বিদেশি ফলের মধ্যে জিনসিং, পার্সিমন, জয়তুন, এপ্রিকট, এগফ্রুট, ক্যাপেল, জাপাটিকাবা, আইসক্রিমবিন, পানপরাগ, রৌশনিয়া, ম্যাঙ্গোস্টিন, বীজবিহীন বারোমাসি জাম, কাজু বাদাম, মিশরীয় মিষ্টি ডুমুর, অ্যাভোকেডো, রাম্বুটান, ডুরিয়ান, টক আতা কলম, আঙ্গুর (সিডলেস ও কালো) থাই শরিফা, টিস্যুকালচার আপেল, সিডলেস বাতাবি লেবু, পুলাসান, মিরাক্কেল ফল, ব্ল্যাকবেরি, কিউই, দারজিলিং কমলা, চায়না কমলা, আঠা ও ভোতাবিহীন কাঁঠাল, পিংকালার, ভেরিকেট ও বারি মাল্টা, বিশ্বব্যাপী সমাদৃত অতি মূল্যবান আম, তাইওয়ান গ্রিন, থাই কাচামিঠা, ভিয়েতনামি বারোমাসি, ডকমাই, আমেরিকান কেন্ট, থাই জাম্বুরা, চাকাপাত, মেহেদী, পলমল, ব্রুনাই কিং, লেডিজোন, এগ অব সান, কিউজাই, সিডলেস কাটিমন, চৌষা, রঙ্গিন তোতাপুরি, সিডলেস পেয়ারা, থাই পেয়ারা ইত্যাদি। দেশি ফলের মধ্যে চারা ও কলম উৎপাদিত হচ্ছে জলপাই, পেঁপে, আতা, গোলাপজাম, কামরাঙ্গা, আমড়াসহ নানা প্রজাতির।
বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারকেল ও কাঁঠালের কলম চারা। সেন্টারের আশেপাশে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে কাশ্মিরি কুল, বলসুন্দরী কুল ও সিডলেস কুলও। বাড়ির আঙিনায়ও এসব ফলের চাষ করছেন অনেকে। নিজেদের চাহিদা পূরণ শেষে বাজারে বিক্রি করে সচ্ছলতা আসছে সেসব পরিবারে।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার চন্দ্রদিঘলীয়া গ্রামের মাল্টাচাষি শাহজাহান মোল্লা বলেন, ‘প্রশিক্ষণ নিয়ে দুই বিঘা জমিতে প্রায় এক হাজার ২০০ মাল্টার চারা লাগিয়েছি। গাছে ফলও এসেছে খুব ভালো। প্রতি বছর দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বিক্রি হয়। এ বছর কোরবানির ঈদের পর ফল পাড়া শুরু হবে। আমাকে দেখে আরও অনেকেই মাল্টার চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।’
কৃষিবিদ আমিনুল ইসলাম আরো বলেন, ইতোমধ্যে কৃষক পর্যায়ে ভিয়েতনামি নারকেল জাতের ৩২ হাজার চারা দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটি গাছে ফল এসেছে। ড্রাগন ফলের চাহিদা থাকায় এ জাতটির সম্প্রসারণেও গুরুত্ব দিয়ে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে সাড়ে তিন হাজার চারা সংগ্রহ করেছেন চাষিরা। তাদের নয়জন এলাকা ছাড়াও ঢাকায় ড্রাগন ফল সরবরাহ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। ব্রাজিল থেকে আনা জাবটিকাবা ফলের চারা উৎপাদনে বেশ কয়েকটি মাতৃগাছ রয়েছে এখানে। দেশের অন্য হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতেও এ জাত সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সেন্টারের উপ-সহকারী উদ্যান কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম প্রধান বলেন, এখানকার আমের মধ্যে জনপ্রিয় জাতের নতুন দুটি জাত গৌরমতি ও ব্যানানা ম্যাংগো ভ্যারাইটি হিসেবে উৎপাদনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এ জাতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাধারণ জাতের আম যখন বাজারে থাকবে না, তখন অফ সিজনে এ আম বাজারে পাওয়া যাবে। লিচুর জাতের মধ্যে চায়না ২, ৩ মোম্বাই, বেদেনা ও মোজাফ্ফরপুরী বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
সেন্টারের উদ্যানতত্ত্ববিদ রাকিবুল হাসান বলেন, বছরব্যাপী এই সেন্টারে উদ্যান ফসল সম্প্রসারণ, মাতৃবাগান সৃজন, জার্মপ্লাজম সংরক্ষণ, মানসম্মত বীজ, চারা ও কলম উৎপাদন এবং বিক্রি করা হয়। দেশ-বিদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত ফল, ফুল, কন্দাল ও সবজির জাতগুলো সংগ্রহ এবং এ জাতগুলোর এদেশের মাটি ও আবহাওয়ার উপযোগিতা যাচাইসহ নানাবিধ কাজ করে থাকে হর্টিকালচার সেন্টারগুলো। উদ্যান ফসলের ওপর প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়।
গুণগতমান ও জবাবদিহিতা থাকায় হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতে এসে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। সেন্টার থেকে নতুন মানসম্মত চারা ও কলম কম দামে কিনে চাষি এবং উদ্যোক্তারা বাগান সৃষ্টিতে উৎসাহী হয়ে থাকেন। দেশের চাহিদা অনুসারে ফল উৎপাদনে হাতের কাছে হর্টিকালচার সেন্টার থাকায় এর গ্রহণযোগ্যতা, আস্থা ও জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আমিনুল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলায় অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে চালু হয় কাশিয়ানী হর্টিকালচার সেন্টার। প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় বছরে চারা ও কলম চারা বিক্রি করে এ পর্যন্ত ৩০ লাখ ২৫ হাজার টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরেই হয়েছে ১০ লাখ ১০ হাজার ৫০০ টাকা। এখানে সবচেয়ে বেশি রয়েছে আমের চারার চাহিদা। এজন্যে এ বছর সোয়া লাখ আমের চারা-কলম উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ চলছে। ফুল ও ফলের চারার মূল্য সরকার নির্ধারিত, যা প্রকারভেদে ৫ টাকা থেকে ৮০ টাকা।
তিনি আরও বলেন, ‘তবে প্রয়োজনের তুলনায় লোকবল সংকট রয়েছে। আমাদের আবাদি জমির পরিমাণ ও অবস্থান অনুসারে মঞ্জুরিকৃত জনবল সংখ্যা ৩৩ জন, যার বিপরীতে কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন ১৫ জন। সবচেয়ে বেশি পদ শূন্য রয়েছে ফার্মলেবারের । ১৬টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র চারজন। এজন্য বাইরে থেকে দিনমজুর এনে কাজ করাতে হয়। নিয়মিত ফার্মলেবার না থাকায় মাতৃগাছ ও চারা গাছের নিয়মিত পরিচর্যায় সমস্যা হচ্ছে।’
সান নিউজ/ এআর