নিজস্ব প্রতিবেদক:
খুলনা: গার্মেন্টস কারখানা গড়ার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে জাতিসংঘের ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ স্বীকৃতি পাওয়া খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামের ১৭ বছরের আঁখির। খুলনা-৪ (রূপসা) আসনের সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মূর্শেদী ও তার স্ত্রী সমাজসেবী সারমিন সালাম তাকে পোশাক কারখানার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ উপহার দিয়েছেন।
প্রায় ১৫ লাখ টাকা মূল্যমানের যন্ত্রাংশগুলোর মধ্যে রয়েছে আটটি বিদ্যুৎচালিত অত্যাধুনিক সেলাই মেশিন (জাকি) ও পাঁচটি পা’চালিত বাটার ফ্লাই সেলাই মেশিন।
শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সকালে রূপসা উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে আঁখির হাতে যন্ত্রাংশ তুলে দেওয়ার অনুষ্ঠানে সালাম মূর্শেদী এমপি জানান, এই যন্ত্রাংশ দিয়ে আঁখি যেন পোশাক কারখানা শুরু করতে পারেন, সেজন্য সরকারি জমি বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে। জমি পেলেই তিনি সেখানে ঘর বানিয়ে আঁখির জন্য পোশাক কারখানা তৈরি করে দেবেন। এই অত্যাধুনিক সেলাই মেশিনগুলো ব্যবহার করতে আঁখিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থাও করবেন।
আঁখি জানান, তিনি এমপি ও তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, তিনি এমন একটি পোশাক কারখানা গড়তে চান, যে কারখানায় তার মতো অসহায় তরুণীরা কাজ করবেন। যন্ত্রাংশগুলো পাওয়ায় তার এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে।
গত মার্চ মাসে করোনা ভাইরাস যখন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন দেশে মাস্কের সঙ্কট দেখা দেয়, বাজারে চড়া দামে মাস্ক বিক্রি হতে থাকে। সে সময় তরুণী আঁখি তার সেলাই মেশিন দিয়ে মাস্ক তৈরি করে কম দামে এলাকার লোকজনের কাছে বিক্রি করেন। সহায় সম্বলহীন অনেক মানুষকে বিনামূল্যে মাস্ক বিতরণ এবং মাস্ক ব্যবহারে সচেতনতা গড়ে তোলেন। তার এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়, যা জাতিসংঘের নজরে আসে।
এরই ফলশ্রুতিতে গত ১৯ আগস্ট বিশ্ব মানবতা দিবস উপলক্ষে আঁখিসহ বাংলাদেশের আরও তিন যুবককে ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয় সংস্থা (ইউএনওসিএইচএ)। অন্য তিন যুবক হলেন, ডাকসুর প্রাক্তন সদস্য তানবীর হাসান সৈকত, ব্র্যাকের প্রকৌশলী রিজভী হাসান এবং অনুবাদক সিফাত নূর।
আঁখি বলেন, ‘আমি খুবই খুশি। আমি কখনো ভাবতেও পারিনি, জাতিসংঘ থেকে স্বীকৃতি পাবো। করোনা ভাইরাস শুরুর দিকে বাজারে মাস্ক পাওয়া যাচ্ছিল না। কিছু কিছু দোকানে পাওয়া গেলেও সেগুলোর দাম ছিল অনেক। আমাদের এলাকার দরিদ্র লোকেরা সেগুলো কিনতে পারতেন না। অথচ করোনা থেকে মুক্ত থাকতে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। তাই আমি নিজেই মাস্ক তৈরি করে কম দামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যেন এলাকার দরিদ্র মানুষসহ সবাই মাস্ক পরতে পারেন। যাদের একদম টাকা-পয়সা নেই, তাদেরকে বিনামূল্যে মাস্ক দিয়েছি।’
পারিবারিক সূত্র জানায়, আঁখির বাবা ভূমিহীন ভাসমান মাসুদ মোল্লা (৪৭) চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কাজ করতেন। সেখানে কর্মরত অবস্থায় তিনি দুর্ঘটনার শিকার হন এবং শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েন। এরপর আঁখির মা আনোয়ারা বেগমও (৪০) চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় যোগ দেন। কিন্তু তার একার রোজগারে সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে ওঠে। আঁখি তখন মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছিলেন। মাকে সাহায্য করতে তিনিও বড় বোনের সঙ্গে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কাজে যোগ দেন। ফলে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
দুই বছর আগে ওয়ার্ল্ড ভিশনের ‘জীবনের জন্য প্রকল্প’ আঁখিকে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা থেকে ছাড়িয়ে এনে স্কুলে ভর্তির উদ্যোগ নেয়। কিন্তু আঁখির বয়স বেশি হয়ে যাওয়ায় কোনো স্কুলে ভর্তি করানো যায়নি। পরে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে সেলাই প্রশিক্ষণ এবং একটি সেলাই মেশিন ও কিছু থান কাপড় পান তিনি। ঘরে বসেই এলাকার লোকজনের পোশাক সেলাই করে আঁখি তাদের চার সদস্যের পরিবারের দায়িত্ব নেন।