ছবি: সংগৃহীত
ফিচার

রংপুর বিভাগে বাল্যবিবাহের হার ৬৮.৮

গাইবান্ধা প্রতিনিধি: দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক নেতা, ধমীয় নেতাগণ বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতার বৃদ্ধির জন্য কাজ করলেও এখনো সাধারণ মানুষ মেয়েদের পরিবারের বোঝা মনে করে। ফলে বাল্যবিবাহের প্রবণতা কমচ্ছে না।

আরও পড়ুন: জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ব

প্রশাসন নানা উদ্যোগ নিলেও বাল্যবিয়ে বন্ধে অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য নয়।

বিশেষজ্ঞগণ বলেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ করলে বাল্যবিবাহের হার কমিয়ে আনা যাবে। রংপুর নগরীর এরশাদ নগর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করে ইতি (১৫) নামে এক কিশোরী। যে বয়সে লেখাপড়া ও বন্ধুদের সঙ্গে হেসে-খেলে বেড়ানোর কথা, সেই বয়সে দেড় বছরের সন্তানসহ স্বামীর সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন: জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস

১২ বছর বয়সে বিবাহ হওয়ায় এখন ইতির জীবন অনেকটাই টাল-মাটাল। ইতি, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মনিরা, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মল্লিকা বা স্বামী পরিত্যক্তা টুম্পাদের মতো অনেককেই বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

বেসরকারি চাকুরীজীবি আব্দুল হালিম বলেন, সামাজিক অসচেতনতা, অভিভাবকদের শিক্ষার অভাব ও দারিদ্রতার কারণে পরিবারে মেয়েদের বোঝা মনে করা হচ্ছে। তাই নানা উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও বাল্যবিবাহ কমছে না।

ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের বাল্যবিবাহ হয় বেশি। যে মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়, সে উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এছাড়া অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করতে গিয়ে স্বাস্থ্যহানি ঘটে, এমনকি মৃত্যুও ঘটে।

আরও পড়ুন: সড়ক নিরাপত্তায় ৬ দফা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাচ্চাসহ কম বয়সে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তখন ওই মেয়ে নিজের সংসার চালাতে গিয়ে নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়।

দর্শনা বাছিরন নেছা বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন ইতির তিন বছর আগে বিবাহ হয়। দরিদ্র বাবা-মায়ের কন্যা দায় থেকে মুক্তির জন্য এমন সিদ্ধান্তের করণে ইতির জীবনে অন্ধকার নেমে আসে।

বিবাহের তিন বছর না যেতেই দুই সন্তানের মা হয় সে। ভ্যান চালক স্বামীকে নিয়ে ইতি এখন এরশাদ নগরের একটি ভাড়া বাসায় থাকে।

আরও পড়ুন: চলতি সংসদের শেষ অধিবেশন বিকেলে

হতাশ কন্ঠে ইতি বলেন, বাড়িঘর দেখে নাই, অন্য কিছু দেখে নাই। বিয়া দিয়াই মনে হয় রেহাই পাইছে। বাবা-মায়ের দোষ দিয়ে লাভ নাই, আমার ভাগ্যে ছিল।

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী মনিরা ১৪ বছর বয়সে ৬ মাস বয়সি এক শিশুর মা হয়েছে। যদিও পৃথিবীর মারপ্যাঁচ কিছুই বুঝে না মনিরা।

রংপুর আশরতপুর বস্তিতে মনিরার বাবার বাড়িতে দেখা যায়, কোলে সন্তান রয়েছে। কোলের সন্তান কিছুক্ষণ পরপর কাঁদলেও সেদিকে তেমন কোনো মনোযোগ নেই তার। একটু পর পর অকারণে হাসছে মনিরা।

কথা বলার চেষ্টা করলেও মনিরা শুধু হাসি ছাড়া আর কোনো কথা বলতে পারেনি। মনিরার মা মঞ্জু বেগম বলেন, মেয়েটা কিছু বুঝে না। ওই জন্য খুব চিন্তায় ছিলাম। দেড় বছর আগে পাশের বস্তির এক ছেলের সাথে বিয়ে দিই।

আরও পড়ুন: সমুদ্রবন্দরে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত

বিয়ের পর মেয়েটা মাত্র একমাস ছিল শ্বশুরবাড়িতে। এখন একটা বাচ্চা হইছে। ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজন কোনো খোঁজ-খবর নেয় না। জামাই আর আসে না।

মনিরার বাবা কাশেম মিয়া বলেন, আমরা গরিব মানুষ। অল্প বয়সে বেটিকে বিয়ে দিতে পারলে বাঁচি। কিন্তু আমার অবুঝ মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে চিন্তা আরও বেড়ে গেছে। এখন বুঝছি কত বড় ভুল হয়েছে। এ ভুল সারা জীবনেও শোধরাতে পারবো না।

জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএ-এর সবশেষ প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। সংস্থাটির ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ মেয়ের বিবাহ হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: রাষ্ট্রপতির সুস্থতা কামনা করলেন মুর্মু

১৫ বছর বা তার কম বয়সি মেয়ের ক্ষেত্রে এই হার ২৭ শতাংশ। গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর চরাঞ্চল ও গ্রামাঞ্চলের ছেলে-মেয়েদেও বাল্যবিবাহ দেওয়া হচ্ছে। ফলে অপুষ্টিত্ব নিয়ে শিশু জন্ম গ্রহণ করছে। বাল্যবিবাহের শিকার কিশোরীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে।

নাম প্রকাশের অইচ্ছুক এক এ্যাডভোকেট বলেন, বাল্যবিয়ে বন্ধে আইন করা হয়েছে। এরপরও বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়নি। সবশেষ ২০১৭ সালে নতুন করে বাল্যবিবাহ বন্ধের আইন পাস করা হয়।

এ আইনে তৃণমূল পর্যায় থেকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ের কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে বাল্যবিবাহ বন্ধের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টগণ নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে বাল্যবিবাহ সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন হবে।

আরও পড়ুন: মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ১৮

তিনি আরও বলেন, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ছাড়াও বাল্যবিবাহ করলে যেসব শাস্তির বিধান রয়েছে, তা প্রয়োগ তেমন দেখা যায় না। বাল্যবিবাহ বন্ধে জনসচেতনতা যেমন জরুরি, তেমনই আইনের প্রয়োগও করতে হবে।

প্রচলিত আইনে যেসব সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিকভাবে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না, তার প্রমাণ এখনো বাল্যবিবাহ হচ্ছে।

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা আরডিআরএস-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রংপুর বিভাগে ১৮ বছরের নিচে বিবাহ হয় অন্তত ৬৪.৮ ভাগ কন্যা সন্তানের। আর ১৫ বছরের নিচে বিবাহ হয়ে যায় ১৬.৮ শতাংশের।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ সংগঠিত হয় শহরের বস্তি এলাকা আর চরাঞ্চলগুলোতে। দারিদ্র্যতা, শিক্ষার অভাব, নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করাসহ সচেতনতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।

আরও পড়ুন: আজও ঢাকার বায়ু অস্বাস্থ্যকর

আরডিআরএস বাংলাদেশ-এর কো-অর্ডিনেটর শমসেয়ারা বিলকিস বলেন, সারা দেশের মধ্যে উত্তরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিবাহ হচ্ছে। শুধু যে দরিদ্র বা অল্প শিক্ষিত পরিবারে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে, তা নয়। এমনকি শহরে অনেক শিক্ষিত পরিবারেও বাল্যবিবাহ হচ্ছে।

স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মুকেমুজান্নাতুন নেছা মমু বলেন, বাল্যবিবাহের কারণে নারীর প্রতি সহিংসতা, অপরিণত গর্ভধারণ, মাতৃমৃত্যু ঝুঁকি, প্রসবকালীন শিশুর মৃত্যুঝুঁকি ও প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে মা ও শিশুর মৃত্যুহার শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

আরও পড়ুন: ভূমিকম্পে কাঁপল কাঠমান্ডু

প্রতিটি শিশুর সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিত করার জন্য বাল্যবিবাহ বন্ধে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবিএম নুরুল্লাহ।

তিনি বলেন, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূলের যে লক্ষ্যমাত্রা, সেটি শতভাগ পূরণ করতে হলে সরকারকে আরও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সান নিউজ/এনজে

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

লক্ষ্মীপুরে চাষ হচ্ছে সৌদির আজওয়া খেজুর

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি: মরুর দেশ সৌদি আরবের বিখ্যাত আজওয়া খেজু...

ঢাকা কলেজ-সিটি কলেজ শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজধানীর সায়েন্সল্যাবে ঢাকা কলেজ ও সিটি ক...

আ’লীগকে নির্বাচনে আনতে চাই বলিনি

নিজস্ব প্রতিবেদক : আমরা কাউকে নির্বাচনে আনতে চাই, এমনটা বলিন...

কিয়েভে দূতাবাস বন্ধ করলো যুক্তরাষ্ট্র

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে বিমান হামলার ভয়...

ডেঙ্গুতে আরও ৫ জনের প্রাণহানি

নিজস্ব প্রতিবেদক : সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্ট...

ইজিপির দায়িত্ব নিয়েছেন বাহারুল 

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি)...

ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার হামলা 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : এবার ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ায় হ...

রংপুরে ভূমিকম্প অনুভূত

জেলা প্রতিনিধি: রংপুর ও আশপাশের এলাকায় ৩.১ মাত্রায় ভূমিকম্প...

চব্বিশের নায়ক খুঁজলে শিবিরকে প্রথম সারিতে পাবেন

নজরুল ইসলাম জিসান, ইবি : শিবিরের একটি প্রাসঙ্গিক সংগঠনের নাম...

সাবেক সচিব নাসির নতুন সিইসি

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে নিয়...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা