রাকিব হাসান:
অন্যসব দিনগুলোর থেকে আজকের দিনটি মিথিলার কাছে ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। ছোট মিথিলার আজ ঘুম ভাঙে এলাকার মাইকের আওয়াজে। মাইকে একের পর এক দেশাত্মবোধক গান এর মধ্যে যে গানটি ছোট এই মেয়েটির মনে নাড়া দিয়েছে তা হলো ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই’।
কৌতূহলী ছোট মেয়ে মিথিলার মনে প্রশ্ন জাগে এই বঙ্গবন্ধু কে এবং সে মারা না গেলে কি হতো!
কৌতূহল থেকেই মায়ের কাছে মেয়ের প্রশ্ন। মা এই বঙ্গবন্ধু কে এবং তিনি মারা না গেলে কি হতো?
ছোট মেয়ের প্রশ্ন শুনে মা তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে রইলেন। পরে মা মেয়েকে বললেন বঙ্গবন্ধু আর কেউ নয় তিনি হলেন আমাদের জাতির পিতা। তার নেতৃত্ব ও তার ত্যাগের বিনিময়েই আমরা এই সুন্দর এবং স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। তিনি ছিলেন অসীম সাহসের অধিকারী। যিনি কিনা স্বাধীনতা এনে দিয়ে বাঙালির মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন, তাঁকেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের এই দিনে সপরিবার হত্যা করে জাতিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
মা তাকে কারা হত্যা করেছিল?
১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট। দিনটি তেমন খুব একটা ভালো ছিল না। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছিল অযথাই উত্তেজনা। পরদিন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে। নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা সতর্ক তা নিয়েই। কিন্তু কে জানত সে সময় উত্তরপাড়ায় চলছে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথেই সক্রিয় হয়ে উঠল সেনাবাহিনীর টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানবাহী শকট যানগুলো। রাত ১০টায় বেঙ্গল ল্যান্সারের টি-৫৪ ট্যাংকগুলো রাজকীয় ভঙ্গিতে এসে জড়ো হলো বিমানবন্দরের বিস্তীর্ণ বিরান মাঠে। জড়ো হলো ১৮টি কামান ও ২৮টি ট্যাংক। রাত সাড়ে ১১টার দিকে জড়ো হলো মেজর ডালিম, মেজর নূর ,মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর রাশেদসহ ঘাতকরা। ১৫ আগস্টের প্রথম প্রহর রাত সাড়ে ১২টায় পরিকল্পনা ব্রিফিং করে মেজর ফারুক। এই প্রথম সবাই জানতে পারল সে রাতেই হত্যা করা হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
তখন ভোর সোয়া ৫টা। ঘাতকেরা আক্রমণ করেছে ধানমন্ডিকে। চারদিকে ছুটছে বুলেট। ভোর ৫টা ১০মিনিটে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন দুই ট্রাক সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হয় ধানমন্ডির শেখ মণির বাসার গেটে। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো তখন ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন শেখ ফজলুল হক মণি। ড্রয়িং রুমে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে মোসলেম। কিছু বলতে চাইছিলেন শেখ মণি। কিন্তু সে সুযোগ আর পেল না মনি, গর্জে উঠল মোসলেমের হাতের স্টেনগান। লুটিয়ে পড়লেন শেখ মণি। তার চিৎকার শুনে এগিয়ে এলেন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। ব্রাশ ফায়ারে প্রাণ হারালেন তিনিও। কেবল প্রাণে বেঁচে গেলেন শেখ মণির ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস।
ছোট মেয়ে মিথিলার প্রশ্ন, মা তার পরে কি হয়েছে?
ভোর তখন ৫টা ১৫ মিনিট। ধানমন্ডির আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণ চালায় এক প্লাটুন সেনা সদস্য। পাহারারত পুলিশকে নিরস্ত্র করতে ছোড়া হয় এলোপাথাড়ি গুলি। গুলির শব্দ শুনে জেগে ওঠেন সেরনিয়াবাত। ব্যস্ত হয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ফোন করতে। সে সময় দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে ঘাতকরা। ড্রয়িং রুমে জড়ো করা হয় সবাইকে। তারপর নির্দয়-ভাবে ব্রাশ ফায়ারে খুন করা হয় আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ১৪ বছর বয়সী মেয়ে বেবী, ১২ বছরের ছেলে আরিফ, ৪ বছরের নাতি বাবু (আবুল হাসনাত আবদুল্লার ছেলে), ভাতিজা শহীদ সেরনিয়াবাত, ভাগনে আবদুল নইম খান রিন্টু (আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর খালাতো ভাই), তিন অতিথি এবং চার কাজের লোককে। কেবল আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে যান সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে হাসনাত।
মায়ের কথা শুনতে শুনতে ছোট মেয়ে মিথিলার চোখ টলমল করছিল। চিকন কণ্ঠে বলতে থাকে এরা এতো নিষ্ঠুর কেন মা? পরে কি হলো?
তখন সময় ভোর সাড়ে ৫টা। সব অপারেশন শেষ করে ঘাতকদের ভিড় এখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটে। ততক্ষণে আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে খুন করার খবর জেনে গেছেন বঙ্গবন্ধু। প্রধান গেটেও তখন চলছে হট্টগোল। বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরের বারান্দায় ঘুমিয়ে ছিলেন ২ গৃহকর্মী মোহাম্মদ সেলিম (আবদুল) ও আবদুর রহমান শেখ (রমা)। নিচতলায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলাম। মহিতুলকে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ চালিয়েছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা...।’কিন্তু পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করে কোনো সাড়াশব্দ পেলেন না মহিতুল। চেষ্টা করতে থাকেন গণভবন (তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়) এক্সচেঞ্জে।
গোলাগুলির শব্দ শুনে বারান্দায় এসে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঘুম ভেঙে যায় গৃহকর্মী আবদুল আর রমার। বেগম মুজিবের কথায় রমা নিচে নেমে দেখেন, সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। ভীতসন্ত্রস্ত রমা বাড়ির ভেতরে এসে দেখেন, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন। রমা দোতলায় উঠে গেলেন। দেখলেন, আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন বেগম মুজিব। রমা এবার চলে যান তিনতলায়। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে। ঘটনা শুনে শার্ট-প্যান্ট পরে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল।
তার পিছু পিছু সুলতানা কামাল আসেন দোতলা পর্যন্ত। তিনতলা থেকে আবারও দোতলায় নেমে আসেন রমা। ঘুম থেকে ডেকে তোলেন শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকেও। জামা-কাপড় পরে শেখ জামাল তার স্ত্রীকে নিয়ে দোতলায় বেগম মুজিবের কক্ষে আসেন। বাইরে তখন গোলাগুলি। নিচতলার অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধু। তার সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার একপর্যায়ে মহিতুলের কাছ থেকে রিসিভার টেনে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব...।’ ব্যস, এ পর্যন্তই। কথা শেষ হলো না তার।
জানালার কাচ ভেঙে এক ঝাঁক গুলি অফিসের দেয়ালে এসে লাগে। এক টুকরো কাচে ডান হাতের কনুই জখম হয় মহিতুলের। টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাছে টেনে শুইয়ে দেন মহিতুলকেও। এর মাঝেই আবদুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলির শব্দ থামলে উঠে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধু। পাঞ্জাবি ও চশমা পরেন। অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?’ এ কথা বলেই উপরে চলে যান বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই নিচে নামেন শেখ কামাল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আর্মি আর পুলিশ ভাইরা, আপনারা আমার সঙ্গে আসেন। ’শেখ কামালের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান মহিতুল ইসলাম ও পুলিশের ডিভিশনাল সুপারিন্টেনডেন্ট (ডিএসপি) নূরুল ইসলাম খান। ঠিক তখনই সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢোকে মেজর নূর, মেজর মুহিউদ্দিন (ল্যান্সার) এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা।
গেটের ভেতর ঢুকেই তারা ‘হ্যান্ডসআপ’ বলে চিৎকার করতে থাকে। মহিতুল ইসলামকে টেনে ঘরের ভেতর নিয়ে যান নূরুল ইসলাম খান। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শেখ কামালের পায়ে গুলি চালায় বজলুল হুদা। লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। মহিতুলকে বলতে থাকেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল। আপনি ওদেরকে বলেন।’ মহিতুল ঘাতকদের বলেন, ‘উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’ আর তখনই বজলুল হুদার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝাঁজরা করে দেয় শেখ কামালের দেহ। প্রাণ হারান তিনি। একটা গুলি এসে লাগে মহিতুলের হাঁটুতে, আরেকটা নূরুল ইসলামের পায়ে।
নিচতলার বারান্দা তখন যেন রক্তে ভাসছে। বন্ধ ঘরের ভেতর ফোনে ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু। ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে জানান, ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকেরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’ তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকে নিজেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তাকে বলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে (শেখ কামাল) বোধহয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ ফোনের ওপাশ থেকে সফিউল্লাহ বলেন, ‘আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং, ক্যান ইউ গেট আউট?’
বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে ব্যক্তিগত লালরঙের গাড়িটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার উদ্দেশে রওনা দেন কর্নেল জামিল। সঙ্গে ছিলেন নিজের গাড়িচালক আয়েন উদ্দিন মোল্লা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পৌঁছানো হলো না তার। পথেই সোবহানবাগ মসজিদের কাছে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে পাষাণ ঘাতকরা। পালিয়ে প্রাণ বাঁচান আয়েন উদ্দিন। তখন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে লম্বালম্বি লাইনে দাঁড়ানো মহিতুল, নূরুল ইসলাম, আবদুল মতিন ও পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যসহ কয়েকজন। ঘাতকদের একজন পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যকে গুলি করে। এরপর গুলি করতে করতে চলে যায় ওপরে। সেখানে শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া আবদুলকে গুলি করে হত্যা করে তারা। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ আবদুল সিঁড়ির পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকেন।
ভোর তখন প্রায় ৫টা ৫০ মিনিট। বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনিসহ বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। বন্ধ দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ঘাতকরা। ততক্ষণে গোলাগুলি থেমে গেছে। দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে ফেলে ঘাতকরা। নামিয়ে আনতে থাকে নিচে। সিঁড়ির মুখে মেজর হুদাকে দেখেই বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে ওঠেন, ‘তোরা কী চাস? তোরা কি আমাকে মারতে চাস?’ মেজর হুদা বলে, ‘আমি আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তুই আমাকে মারতে চাস? কামাল কোথায়? তোরা কামালকে কী করেছিস?’ উত্তরে হুদা বলে, ‘স্যার, কামাল তার জায়গায়ই আছে। আর আপনি তুই তুই করে বলবেন না। আপনি বন্দি। চলুন।’ এবার গর্জে উঠলেন বঙ্গবন্ধু ‘কী, তোদের এত সাহস! পাকিস্তান আর্মিরা আমাকে মারতে পারেনি। আমি বাঙালি জাতিকে ভালোবাসি। বাঙালি আমাকে ভালোবাসে। কেউ আমাকে মারতে পারে না।’
সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে দাঁড়াতেই সিঁড়ির নিচে অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও মেজর নূর। নূর কিছু একটা বললে সরে দাঁড়ায় মহিউদ্দিন। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে হুদা ও নূরের হাতের স্টেনগান। আঠারটি গুলি ঝাঁজরা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের বুক ও পেট। বিশালদেহী মানুষটি ধপাস করে পড়ে যান সিঁড়ির ওপর। বঙ্গবন্ধু তখন মৃত। তার বুকের রক্তে ভেসে যায় সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে সেই রক্তের স্রোত।
কিছুক্ষণ পরই দোতলায় উঠে আসে মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন। সঙ্গে সৈন্যরা। গুলি আর ধাক্কায় একসময় দরজা খুলে সামনে দাঁড়ান বেগম মুজিব। সবাইকে নিচে নেমে আসার নির্দেশ দেয় পাষাণ ঘাতকরা। নিচে নামতে থাকেন বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমা। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বেগম মুজিব। চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘আমি যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেল।’ শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও রমাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় বেগম মুজিবকে। তারপর সেই ঘরে আজিজ পাশা ও রিসালদার মোসলেউদ্দিন একে একে গুলি করে হত্যা করে বেগম মুজিবসহ শেখ জামাল, সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। বেগম মুজিবের নিথর দেহটি ঘরের দরজায় পড়ে থাকে। বাঁ-দিকে পড়ে থাকে শেখ জামালের মৃতদেহ। রোজী জামালের মুখে গুলি লাগে। আর রক্তক্ষরণে বিবর্ণ হয়ে আসে সুলতানা কামালের মুখ।
নিচে দাঁড় করানো হয় শেখ নাসের, শেখ রাসেল আর রমাকে। শেখ নাসের ঘাতকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি তো রাজনীতি করি না। কোনো রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই। আমাকে কেন মারবে?’ অফিস সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। গুলি করা হয় সেখানে। অসহায় নাসেরের গুলিবিদ্ধ দেহ গড়াতে থাকে মেঝেতে। এ সময় ‘পানি... পানি...’ বলে গোঙাতে থাকেন তিনি। পানি নয়, ঘাতকরা আরেকবার গুলিবর্ষণ করে তার ওপর।
রমাদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলও। অসহায় শিশুটি প্রথমে রমাকে ও পরে মহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো?’ কোনো জবাব নেই রমার মুখে। মহিতুল বলেন, ‘না ভাইয়া, তোমাকে মারবে না।’ একথা শুনে শিশুটি তার মায়ের কাছে যেতে চায়। দোতলায় নিয়েও যাওয়া হয় তাকে। কিন্তু মা নয়, পাঠানো হয় মৃত্যুর কোলে। গুলি করে হত্যা করা হয় শিশুটিকে। নিথর রক্তমাখা একরত্তি দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামালের পাশে।
তবে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন না। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা স্বামীর সঙ্গে ছিলেন জার্মানিতে। তাদের সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও। তাই বেঁচে যান তারা।
মায়ের মুখে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা শুনে চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়তে থাকে ছোট মেয়ে মিথিলার। পাষাণ এই ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করতে পারলেও তার আদর্শ ও তার দেখানো পথ এই বাংলার বুক থেকে কখনও হত্যা করতে পারেনি। যুগে যুগে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবে বাংলার মানুষের হৃদয়ে।
সান নিউজ/ আরএইচ
