নিজস্ব প্রতিনিধি:
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে আপন ভাতিজিকে ধর্ষণ মামলার আসামি সোহেল মাত্র এক মাসের মধ্যে জামিন পাওয়ার পেছনে নির্মমভাবে কলকাঠি নেড়েছেন ধর্ষকের বাবা আবদুল মান্নান। এ কাজে এই বৃদ্ধকে সহায়তা করেছেন ধর্ষকের মামা ও বোন। ফলে তাদের চাপে ধর্ষণের শিকার কিশোরীর অমত সত্ত্বেও তার বাবাকে নতজানু হতে বাধ্য হতে হয়েছে।
আবদুল মান্নান তার ধর্ষক ছেলে বিরুদ্ধে মামলা তুলে না নিলে বড় ছেলে ও ধর্ষিত কিশোরীর বাবাকে সম্পত্তির ভাগ বঞ্চিত করাসহ ভিটে থেকে উচ্ছেদের হুমকি দিয়ে আসছিলেন। আরও অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার মেয়েটির কথা না ভেবে এ কাজে প্রতিবেশীরাও ওই বৃদ্ধের সঙ্গে হাত মেলায় এবং কিশোরীর বাবাকে আপসের জন্য চাপ দিতে থাকে।
এ পরিস্থিতিতে কিশোরীর বাবা অসহায় হয়ে পড়লে তারই সুযোগ নিয়ে ধর্ষক সোহেলকে তার মামা ও বোনের সহায়তায় জামিন করায় তার বাবা আবদুল মান্নান। এমনকি কারাগার থেকে বেরিয়ে গ্রামে ফেরার পর ধর্ষক সোহেলের গলায় মালা পরিয়ে দেয় তার বাবা, পরে মামা ও বোন। সেই মালা পরেই মোটরসাইকেলে শোডাউন করে আপন ভাতিজিকে ধর্ষণকারী সোহেল।
গত ১৭ জুলাই কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার বাঙ্গড্ডা ইউনিয়নের হেসিয়ারা পূর্বপাড়ায় এ ঘটনা ঘটে।
নির্যাতিত কিশোরীর ভাইয়ের অভিযোগ, তার আপন চাচা সোহেল তার বোনকে ধর্ষণের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের অনেক প্রতিবেশী ধর্ষকের বিচার না চেয়ে উল্টো তার পক্ষ নেয়। তারা ধর্ষক সোহেলের জামিনের জন্য একাধিকবার বৈঠকে বসে। এ কাজে তার দাদা আবদুল মান্নান, তার ফুপু রেখা আক্তার এবং মামা ইমাম হোসেন মূল ভূমিকা রাখেন। তারা বারেবারে তার বাবাকে (ধর্ষিত কিশোরীর বাবা এবং আবদুল মান্নানের বড় ছেলে) মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। আর তার দাদা তার ছোট ছেলে ধর্ষক সোহেলকে ছাড়িয়ে না আনলে তার বাবাকে সম্পত্তির ভাগ দেবে না, বাড়ির ভিটে থেকে তাড়িয়ে দেবে সারাক্ষণ এমন হুমকি ও চাপ দিতে থাকে। এ কাজে তার ফুপু রেখা বেশি ভূমিকা রাখে। আরেক মামা নূর হোসেনের ছেলে ইউনুছও তার দাদার সঙ্গে এসে তার বাবাকে এবং তাদের শাসাতে থাকে। অন্য আত্মীয়স্বজনরাও তার দাদার পক্ষ নেয়। সবাই তার বোনকেই দোষ দিতে থাকে যদিও তার বোনের কোনও দোষ ছিল না। বাবা কোনোভাবেই রাজি ছিল না। আমার বোন এখনও রাজি নয়। কিন্তু, ওরা সবাই এমনভাবে চাপ দেয় যে বাবা কোনও কথা বলতো না এ বিষয়ে। এর সুযোগ নিয়ে ওরা ধর্ষক সোহেলের জামিনের জন্য কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আবেদন করে।
কিশোরীর ভাই আরও জানান, বোনের ধর্ষণ মামলায় জামিনে আসার পর তার দাদা অর্থাৎ ধর্ষক সোহেলের বাবা আবদুল মান্নান, মামা ইমাম হোসেন এবং বোন রেখা আক্তার তার গলায় ফুলের মালা পড়ান। এরপর সোহেল মোটরসাইকেল শোডাউন করেন।
রবিবার সকালে ভুক্তভোগী কিশোরী মোবাইল ফোনে গণমাধ্যমকে জানান, তার চাচা সোহেলের দ্বারাই সে ধর্ষণের শিকার হয়। তার অসুস্থ মা হাসপাতালে থাকায় বাবা সেখানে ছিল। বাবা-মা বাড়িতে না থাকার এই সুযোগ নিয়ে প্রথমদিন জোরপূর্বক ধর্ষণ করতে গেলে সেই চিৎকার করার চেষ্টা করলে তার মুখ চেপে ধরে। পরবর্তীতে পরপর আরও তিনদিন তাকে হত্যা ও মেরে ফেলের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণ করে। বিষয়টি কাউকে না বলার জন্য হুমকি দেয়। ওই লোকের জামিনের জন্য সে রাজি ছিল না। এখনও নেই। তার দাদাই তার বাবাকে ভয় দেখিয়ে চুপ রেখে ধর্ষককে জামিন করিয়েছে। এ কাজে তার ফুপু, মামা, মামাতো ভাইরা জড়িত। প্রতিবেশী আর আত্মীয় স্বজনরা এসেও তার বাবাকে চাপ দিয়েছে। এসব দেখে সে শুধুই কেঁদেছে।
মামলার বাদী পক্ষের আইজীবী অ্যাডভোকেট ওবায়দুল্লাহ সরকার জানান, ভুক্তভোগী কিশোরীর বাবা ভাতিজি ধর্ষণ মামলার আসামি সোহেলের জামিনের জন্য কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আপসনামা দিয়ে আবেদন করেন। এফিডেভিট এবং ৩০০ টাকা স্ট্যাম্পের মাধ্যমে কুমিল্লা জেলা ও দায়রা জজ বিচারক আতাবউল্লাহ আসামি সোহেলকে জামিন দেয়।
আসামিকে নিমরাজি থাকতে দেখলেও কিশোরীর প্রসব করা বাচ্চার ডিএনএ রিপোর্ট হাতে না পাওয়ায় বিষয়টি পরিষ্কার হতে পারিনি। তবে ঢাকা থেকে ডিএনএ রিপোর্ট আসলে ধর্ষণের ঘটনাটি প্রমাণিত হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বাবা চাপা ক্ষোভ নিয়ে জামিনের ব্যাপারে কিছুই বলতে চাননি। কথা বলতে চাননি।
এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর স্থানীয়ভাবে সালিশ হয়েছিল কয়েকবার। সে সালিশে ভূমিকা রাখাদের একজন আবু তাহের। তিনি দাবি করেন, ঘটনার প্রথম থেকে সবকিছু জানলেও জামিনের বিষয়ে কিশোরীর বাবাকে চাপ দেওয়ার ঘটনার কিছুই তিনি জানেন না।
জানা গেছে, ভাতিজি ধর্ষণ মামলার আসামি সোহেল বিবাহিত। তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা না বলে তার স্ত্রীকে দেন। তার স্ত্রী জানান, তার স্বামী জেলখানায় ছিলেন। কে তার জামিনের জন্য আবেদন করেছে সেই নিজেই জানতেন না।
তবে ধর্ষক সোহেলের বাবা আবদুল মান্নান ও মামাতো ভাই ইউনূছের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা নাঙ্গলকোট থানার এসআই আক্তার হোসেন। তিনি আসামির জামিন পাওয়ার খবরে অবাক হয়ে বলেন, এখনও ডিএনএ রিপোর্ট আসেনি, তাহলে কিভাবে আসামি জামিন পেলো? তবে আদালতের বিষয় হওয়ায় তিনি আর মন্তব্য করতে চাননি। অবশ্যই আদালত ভালো জানেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের নভেম্বর চাচা সোহেলের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন তার আপন ভাতিজি। এরপর এ কথা প্রকাশ করলে তাকে মেরে ফেরার হুমকি দেয় সোহেল। তবে কিশোরী ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে এলাকায় বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় পর্যায়ে সালিশ বসলে কিশোরী ওই ঘটনার জন্য চাচা সোহেলকে দায়ী করেন।
এরপর ১৪ জুন নাঙ্গলকোট থানায় কিশোরীর বাবার করা ধর্ষণ মামলায় পরদিন ১৫ জুন তার ভাই সোহেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত জুন মাসের শেষ দিকে সিজার অপারেশনের মাধ্যমে ওই কিশোরীর সন্তান প্রসব করে। সেই সন্তানকে দত্তক দেওয়া হয়। এর মধ্যেই ধর্ষকের বাবা আবদুল মান্নানের চাপের কারণে গত মঙ্গলবার (১৪ জুন) ধর্ষক সোহেল কারাগার থেকে বের হয়ে আসে।
শুক্রবার (১৭ জুলাই) তার বাবা আবদুল মান্নান, মামা ইমাম হোসেন ও বোন রেখা তাকে ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। সে মামালা পরে এলাকায় মোটরসাইকেলে শোডাউন করে ধর্ষক সোহেল।