ফিচার ডেস্ক:
বিশ্ব মহামারিতে করোনাভাইরাস দেখিয়ে দিল কতটা ভয়াবহ হতে পারে জনজীবন। এই একটা ভাইরাস মূহুর্তেই থামিয়ে দিল পুরো বিশ্বকে। পৃথিবীতে যতবার মহামারি এসেছে ততবারই কেড়ে নিয়েছে লাখো মানুষের প্রাণ। এসব মহামারি আমাদের স্বাভাবিক জীবনেও নিয়ে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
এমন পরিস্থিতি আবার ফিরে আসুক মানব জীবনে এমনটা অবশ্যই কেউ চাইবে না। তবে প্রকৃতির কিছু খেলা বোঝার সাধ্য আসলে কারোই নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগের এমন একটি তালিকা তৈরি করেছেন যাকে তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। এ তালিকার রোগগুলো যে কোনো সময় মহামারিতে রূপ নেয়ার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে।
চলুন তাহলে সান নিউজের পাঠকদের জানিয়ে দেই এমন কিছু রোগ সম্পর্কে যেগুলো সহসা মহামারিতে রূপ নিতে পারে যে কোন সময়।
রিফট ভ্যালি ফিভার:
রিফট ভ্যালি ফিভার হচ্ছে একটি ভাইরাস জাতীয় রোগ যার উপসর্গ মৃদু থেকে খুবই তীব্র। আমরা প্রায়সময় মৃদু উপসর্গ হিসেবে যা বিবেচনা করি তা হচ্ছে পেশি ব্যথা, মাথাব্যথা ও কাশি; যা অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমণের অনুরূপ। তীব্র উপসর্গগুলো বেশ ভীতিকর, যেমন- দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া ও মস্তিষ্কের সংক্রমণ। মস্তিষ্কের সংক্রমণ থেকে বিভ্রান্তি ও অসহনীয় মাথাব্যথা হতে পারে। কিছু রোগীর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে- এসব কেসে রোগটি প্রায় সময় মৃত্যু ঘটিয়ে থাকে। সংক্রমিত প্রাণীর রক্তের সংস্পর্শে আসলে অথবা সংক্রমিত মশার কামড়ে রোগটি ছড়ায়।
নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ:
নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ হয় নিপাহ ভাইরাস থেকে, যা মালয়েশিয়াতে ১৯৯৮ সালে প্রথম শনাক্ত হয়। এ ভাইরাস সংক্রমণের প্রচলিত উপসর্গ হচ্ছে জ্বর, কাশি, বিভ্রান্তি, শ্বাসকষ্ট ও মাথাব্যথা। এক বা দুই দিন পর উপসর্গগুলো আরো খারাপ হয় এবং সংক্রমিত ব্যক্তি কোমায় চলে যেতে পারেন। নিপাহ ভাইরাস হেনিপাভাইরাসের শ্রেণীতে পড়ে। সাধারণত ফ্রুট ব্যাট নামক বাদুড় থেকে এসব ভাইরাসের উৎপত্তি ঘটে। নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে। এখন অবধি এটির জন্য ভ্যাকসিন নেই।
লাসা ফিভার:
লাসা ফিভার সৃষ্টি হয় লাসা ভাইরাস থেকে। প্রায়শ অধিকাংশ কেসে এ ভাইরাল হেমোরেজিক (শরীরের অভ্যন্তরে অত্যধিক রক্তক্ষরণ) ফিভারে উপসর্গ প্রকাশ পায় না। প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হচ্ছে জ্বর, বমি, দুর্বলতা, মাথাব্যথা ও পেশি ব্যথা। কিছু রোগীর মুখ বা পরিপাকতন্ত্র থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। লাসা ফিভারে মৃত্যুর ঝুঁকি প্রায় ১ শতাংশ। সাধারণত উপসর্গ প্রকাশের দু’সপ্তাহ পর মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। এ রোগটি মানুষের মধ্যে ছড়ানোর সবচেয়ে প্রচলিত কারণ হচ্ছে সংক্রমিত ইঁদুরের সংস্পর্শে আসা। তারপর এটি মানুষ থেকে মানুষের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে ছড়িয়ে পড়ে।
মারবার্গ ভাইরাস রোগ:
মারবার্গ ভাইরাস রোগ হচ্ছে একটি তীব্র অসুস্থতা, যার সঙ্গে ইবোলা ভাইরাস রোগের তুলনা করা যেতে পারে। উভয় ভাইরাসই মানুষ ও মানুষের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণীকে (যেমন- বানর ও বনমানুষ) আক্রান্ত করতে পারে। সাধারণত দুটি পরিচিত মারবার্গ ভাইরাসের একটি দ্বারা মারবার্গ ভাইরাস রোগ হয়ে থাকে। ভাইরাস দুটি হচ্ছে রেভন ভাইরাস (আরএভিভি) ও মারবার্গ ভাইরাস (এমএআরভি)। এ রোগের উপসর্গের সঙ্গে ইবোলা ভাইরাস রোগের উপসর্গের মিল রয়েছে, যার ফলে প্রথমদিকে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ কঠিন হয়ে পড়ে।
ইবোলা ভাইরাস রোগ:
ইবোলা হচ্ছে একটি বেশ পরিচিত ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভার, যা মানুষ ও অন্যান্য প্রাইমেটকে সংক্রমিত করে। ইবোলাভাইরাস নামক ভাইরাসের একটি প্রজাতি দ্বারা এ রোগ হয়। উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হচ্ছে জ্বর, পেশি ব্যথা, গলা ব্যথা ও তীব্র মাথাব্যথা। এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার দু’দিন থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে উপসর্গগুলো প্রকাশ পেয়ে থাকে। এসব উপসর্গের পরে রোগীদের বমি, ডায়রিয়া ও ফুসকুড়ি ওঠে এবং সেইসঙ্গে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এ রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি উচ্চ। ২০১৯ এর ডিসেম্বরে একটি ভ্যাকসিন অনুমোদন পায়।
ক্রিমিয়ান-কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার:
এ ভাইরাস জনিত রোগের উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হচ্ছে পেশি ব্যথা, উচ্চ জ্বর, বমি, ডায়রিয়া, মাথাব্যথা ও রক্তক্ষরণ। রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার দু’সপ্তাহ পর উপসর্গ প্রকাশ পেতে থাকে। এ রোগে লিভার অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। টিক পোকার কামড় ও খামারের সংক্রমিত পশুর সংস্পর্শে ক্রিমিয়ান-কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার হয়। কৃষকেরা এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। রোগটি আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া ও বলকানে বেশি দেখা যায়। এ মুহূর্তে কোনো ভ্যাকসিন নেই।
ডিজিজ এক্স:
এটি হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় সবচেয়ে বিপজ্জনক রোগ। ডিজিজ এক্স আসলে কোনো রোগ নয়, এ তালিকার অন্যান্য রোগের চেয়ে এটি ব্যতিক্রমধর্মী। এটি হচ্ছে, আমাদের পৃথিবীতে বর্তমানে যত অজ্ঞাত ভাইরাস আছে তা বোঝাতে একটি নাম। এসব ভাইরাসের সংখ্যা ১.৬৭ মিলিয়ন। এসব ভাইরাস পৃথিবীতে মানব অস্তিত্বের শুরু থেকেই ধ্বংসলীলা চালিয়ে আসছে। সোয়াইন ফ্লু অথবা সার্স উভয় রোগই শনাক্তকরণের পূর্বে ডিজিজ এক্স হিসেবে শুরু হয়েছিল। আবিষ্কারের পূর্বে ডিজিজ এক্স হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল এমন আরেকটি রোগ হচ্ছে এইচআইভি।
সার্স ও মার্স
আমরা ইতোমধ্যে এ দুটি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখেছি। কিন্তু তাই বলে আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি না যে এগুলো ভবিষ্যতে মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হবে না। এসব রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসগুলো পরিবর্তিত হয়ে ভিন্ন রূপে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। উভয় রোগেই ফ্লু সদৃশ উপসর্গ দেখা দেয়, যেমন- জ্বর, পেশি ব্যথা ও গলা ব্যথা। এসব রোগের কোনো ভ্যাকসিন নেই, যদিও এগুলো কার্যকরভাবে মোকাবেলার জন্য আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে।
জিকা ভাইরাস:
জিকা ভাইরাস হচ্ছে ফ্লাভিভাইরিডাই নামক ভাইরাস পরিবারের একটি সদস্য, যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এ মশাটি দিনে উড়ে বেড়ায়। এ ভাইরাসটি নাম পেয়েছে উগান্ডার জিকা বন থেকে, যেখানে ১৯৪৭ সালে ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত হয়। এ ভাইরাসটি ইয়েলো ফিভার ও ডেঙ্গুর অনুরূপ। ২০১৫ সালে জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। এ ভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ খুবই মৃদু, কিন্তু এখনো পর্যন্ত ভ্যাকসিন উদ্ভাবন হয়নি।
সান নিউজ/সালি