নৌশিন আহমেদ মনিরা: একুশ-বাইশ বছর আগে লাল-নীল বাতির শহর ঢাকায় আসেন রংপুরের মর্জিনা। চোখে ছিলো রঙিন স্বপ্ন। ছিলো স্বপ্নের মতো সংসার। কাজ করতেন পোশাক কারখানায়। তার স্বামী চালাতেন প্রাইভেট কার। রোজগার হতো ভালোই। ছুটির দিনে স্বামীর সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন।
এমনিভাবেই চলছিলো তাদের সংসার। এরইমধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েন মর্জিনা। প্রায়-ই শরীর খারাপ হতো। বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয় চাকরি। এরপর স্বামীর উপার্জনে চলছিলো সংসার। আর্থিক টানাপোড়েন শুরু হলে তিনি বাসা-বাড়িতে কাজ নেন। কিন্তু সেটাও বেশি দিন করতে পারেননি। শরীর দিনকে দিন আরও খারাপ হতে থাকে।
মর্জিনার বাড়ি রংপুর হলেও স্বামীর বাড়ি বরিশাল। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে লাবণী আক্তারের (২০) বিয়ে হয়েছে সম্প্রতি। তার স্বামীও অসুস্থ। দ্বিতীয় ছেলে সজিবের বয়স ১০ বছর। ছোট ছেলে সিয়ামের বয়স ৫ বছর। ছোট দুই সন্তান মায়ের সঙ্গেই রাস্তায় রাস্তায় থাকে।
মর্জিনা জানান, বছর ছয়েক আগে তার প্রাইভেট কার চালক স্বামী দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পান। এরপর বেকার ও অসুস্থ। একপর্যায়ে তাকে ছেড়ে এক গ্যারেজে আলাদা থাকা শুরু করেন। তিনি ৫ বছর ধরে সংসারের কোনও দায়িত্বও নেন না। এই ৫ বছর সন্তানদের নিয়ে কোনও ভাবে টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন মর্জিনা।
স্বামী আলাদা থাকা শুরু করলে আবারও বাসা-বাড়ির কাজ নেন তিনি। এবারও অসুস্থতার জন্য বেশি দিন কাজ করতে পারেননি। এরপর নামেন রাস্তায়। শুরু করেন তোয়ালে বিক্রি। ফুটপাতে তোয়ালে বেচেন, রাস্তায় যানজট লেগে গেলে গাড়িতে বেচেন। কখনো রাস্তায় দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের পানি খাওয়ান। এতে কিছু বকশিশ পান। কখনো পথচারীরাও দু’এক টাকা দেন। এভাবে খেয়ে না খেয়ে দিন চলে যাচ্ছে তার।
শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) কারওয়ান বাজার থেকে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের দিকে যেতে ফুটপাতে একটি ঝুঁপড়ি ঘর চোখে পড়ে। ব্যস্ত ফুটপাতে রীতিমতো সংসার পেতেছেন ৪৫ বছরের মর্জিনা। ঘরে রয়েছে চকিও। কোথাও মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে ফুটপাতে আশ্রয় নিয়েছেন। অস্থায়ী এই ঘরে কাগজের বেড়া, মাথার উপর কয়েকটা টিন। রান্নার জন্য রয়েছে ছোট চুলা। ঝড়-বৃষ্টিতেও সেখানেই থাকেন।
মর্জিনা বলেন, পায়ে পঁচন ধরেছিলো। এখন কিছুটা ভালো। করোনার শুরু দিকে অনেকেই সাহায্য করতো। তখন চাল, ডাল, তেল পাওয়া যেত। এখন আর কেউ কিছু দেয় না। খুব কষ্টে আছি। খাওয়ার পানি পাওয়া যায় না। মসজিদ থেকে পানি এনে খাচ্ছি। সন্ধ্যার পর মসজিদও বন্ধ করে দেয়, তখন আর পানি পাওয়া যায় না।
ভূমিহীন দরিদ্রদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘরের কথা শুনেছেন মর্জিনা। তিনি এই প্রকল্পের একটি ঘর চান। ঘর পেলে ঢাকা ছেড়ে রংপুরে চলে যাবেন বলে জানান তিনি।
এই নারী বলেন, আমার থাকার মতো জায়গা নাই। গ্রামেও কোনও জায়গা নাই। তাই ফুটপাতে থাকি, মানুষে গালি দেয়। দুই ছেলেরে লইয়া যাওয়ার জায়গাও নাই। কী আর করবো, স্বামীও খোঁজ নেয় না। শেখ হাসিনা (প্রধানমন্ত্রী) নাকি গরিবদের ঘর দিতাছে। আমারে একটা ঘর দিলে রংপুর চলে যেতাম। ঢাকায় আসার সময় অনেক স্বপ্ন ছিল। প্রথমে ভালোই ছিলাম। আনন্দ ছিল। আস্তে আস্তে সব স্বপ্ন শেষ। এখন খাইতেও পাই না।
তাকে চায়ের টং বা পিঠার দোকান করে দিলে তা দিয়ে গ্রামে দুই সন্তানকে নিয়ে চলতে পারতেন বলেও জানান মর্জিনা।
সাননিউজ/এনএএম/এমকেএইচ