সান নিউজ ডেস্ক : যা কিছুই হোক না কেন, সংখ্যার হিসাব কোনোদিন মিথ্যা বলে না; কারণ নারীরা যে পুরুষের চাইতে বেশিদিন বাঁচেন-এর প্রমাণ রয়েছে। আমেরিকার কথাই ধরা যাক; ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী আমেরিকান পুরুষেরা গড়ে ৭৬ বছর পর্যন্ত বাঁচেন এবং নারীরা বাঁচেন গড়ে ৮১ বছর বয়স পর্যন্ত। অন্যদিকে ২০২০ সালের ডেটা অনুযায়ী, জন্মের সময়ে আমেরিকান পুরুষদের আয়ুষ্কাল ছিল ৭৫ দশমিক ১ এবং নারীদের আয়ুষ্কাল ৮০ দশমিক ৫।
আরো একটি তথ্য হলো এই যে, নারীরা যে অতিরিক্ত বছরগুলো বাঁচেন সেসময় তারা সুস্বাস্থ্য নিয়েই থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার 'এইচএএলই' সূচক দিয়ে কোনোরকম বড় দুর্ঘটনা বা রোগে আক্রান্ত হওয়া ছাড়াই নারী ও পুরুষের বেঁচে থাকার সময়কাল হিসাব করা হয়। সেখানে দেখা গেছে যে, আমেরিকান পুরুষরা ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকেন এবং এক্ষেত্রে আমেরিকান নারীরা ৭০ বছর পর্যন্ত পুরোপুরি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে বেঁচে থাকেন।
নারী পুরুষের আয়ুষ্কালের মধ্যে এ পার্থক্য নতুন কিছু নয়, বরং বিশেষজ্ঞরা এটি দশকের পর দশক ধরে লক্ষ্য করছেন। অস্ট্রেলিয়ার সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডা পারমিন্দার সাচদেব মানষের আয়ুষ্কাল নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, 'এটা শুধুমাত্র আমেরিকার ক্ষেত্রেই নয়, সব সমাজের ক্ষেত্রেই সত্য।'
কিন্তু কেন নারীরা বেশিদিন বাঁচেন? জবাবে সাচদেব বলেন, 'এ ব্যাপারে জনপ্রিয় কিছু তত্ত্ব আছে, এর কিছু কিছু জীববিজ্ঞানের সাথে জড়িত; আবার কিছু কিছু মানব আচরণের সাথে জড়িত।'
'পুরুষেরা তুলনামূলকভাবে বেশি ধূমপান করেন, মদ্যপান করেন এবং অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী হয়ে যান। তারা প্রাথমিক পর্যায়ে ডাক্তার দেখাতেও অনাগ্রহী এবং রোগ ধরা পড়লে তারা নিয়মিত চিকিৎসাও নেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, পুরুষেরা অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ, জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ-এসব কাজ নিজের ঘাড়ে নিয়েন নেন। এই যেমন- গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া কিংবা ঝগড়া-লড়াই বা বন্দুকযুদ্ধে', বললেন সাচদেব।
এর পেছনে বৈজ্ঞানিক প্রমাণও রয়েছে। পুরুষের শরীরে থাকা মেল সেক্স হরমোন টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বেড়ে গিয়ে তাদেরকে এরকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দিকে বেশি ধাবিত করে। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সাথে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের সম্পর্ক রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, টেস্টোস্টেরন আরো অন্যান্য উপায়েও পুরুষের জীবনকাল কমিয়ে আনতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ার ইনহা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক কিউং-জিন মিন বলেন, 'মেল সেক্স হরমোনগুলো তাদের ইমিউন এর কার্যক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় এবং বিভিন্ন কার্ডিওভাসকুলার (হৃদযন্ত্র ও রক্তনালী সম্পর্কিত) রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
২০১২ সালে 'কারেন্ট বায়োলজি' নামক জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় মিন ও তার সহকর্মীরা ৮১ জন কোরীয় হিজড়ার হেলথ রেকর্ড পরীক্ষা করেছেন। এসব হিজড়াদের মধ্যে ছিল এমন সব পুরুষেরা, যাদের ছোটবেলায় খোজা বানানো হয় এবং এর ফলে তাদের দেহে অধিক টেস্টোস্টেরন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। তারা পরীক্ষা করে দেখেন যে এসব হিজড়ারা তাদের একই আর্থ-সামাজিক গোত্রের যেসব পুরুষদের খোজা বানানো হয়নি, তাদের চাইতে ১৪-১৯ বছর বেশি বাঁচেন।
টেস্টোস্টেরন ও ইমিউন এর কার্যক্রমের মধ্যে যোগসূত্র স্পষ্টভাবে পাওয়া না গেলেও; মিনের ল্যাবের গবেষণায় দেখা যায় যে, রোগ প্রতিরোধ করবে এমন কিছু কোষের পথ বন্ধ করে দিতে সক্ষম টেস্টোস্টেরন। অন্যদিকে, টেস্টোস্টেরনের কম মাত্রার সঙ্গে পুরুষের হৃদরোগের ও দুর্বল স্বাস্থ্যের যোগসূত্র পাওয়া গেছে একাধিক গবেষণায়। তাই টেস্টোস্টেরন ও পুরুষ স্বাস্থ্যর মধ্যকার সম্পর্ক বেশ জটিল।
এখানে আমরা বলতে পারি যে, পুরুষের হরমোনকে দোষ দেয়া যায়না; বরং নারীদের হরমোনই তাদের বিশেষ কিছু সুবিধা দিয়ে যায় আজীবন।
সাচদেব বলেন, 'এস্ট্রোজেন হরমোন নারীদের বলতে গেলে সুরক্ষাই দেয়; এর একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভূমিকা আছে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ এন্ডোক্রিনোলজি এর ২০১৩ সালের রিভিউতে দেখা যায়, রোগের কারণ হতে পারে এমন ডিএনএ ক্ষতিকে প্রতিরোধ করতে পারে এস্ট্রোজেন। রিভিউ থেকে আরও জানা যায় যে, এস্ট্রোজেন কোষের কার্যক্রমকে স্বাভাবিক ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
এরকম নানা ধরনের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল আমাদের নারীদের অধিক আয়ুষ্কাল সম্পর্কে যুক্তি দেয়। কিন্তু বিবর্তন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন বাঁচার বৈশিষ্ট্য কেন নারীদেরই দেয়া হলো, পুরুষদের কেন নয়?
সাচদেব বলেন, 'এও সবই আসলে অনুমানমূলক। কিন্তু এর পেছনে নারীদের সন্তান জন্মদান ও লালন-পালন করার ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু সন্তানের টিকে থাকার জন্য একজন মায়ের শরীর সুস্থ ও বলিষ্ঠ থাকা জরুরি। একজন নারীকে গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের শারীরিক কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, কিন্তু এসকল চ্যালেঞ্জ কখনো পুরুষের শরীরকে নিতে হয় না।
একটা প্রবাদই আছে যে, 'যা আমাদের মেরে ফেলেনা, তা আমাদের শক্তিশালী করে।' আর নারীদের ক্ষেত্রেও তাদের সেই শক্তিই তাদেরকে দীর্ঘতর-স্বাস্থ্যোজ্জ্বল জীবন দেয়। সূত্র- টাইম
সান নিউজ/এসএম