সি এলিগ্যান্স ছবি-SCIENCE PHOTO LIBRARY
ফিচার
ইতিহাসের সাক্ষী

এক পোকার দেহকোষের রহস্য

সান নিউজ ডেস্ক: ১৯৫০ এর দশকে ডিএনএ'র গঠন আবিষ্কৃত হবার পর দক্ষিণ আফ্রিকান জীববিজ্ঞানী সিডনি ব্রেনার এমন একটা প্রাণী খুঁজছিলেন - যা তাকে মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক আচরণের পেছনে যে জীনগুলো কাজ করে তা চিহ্নিত করতে সহায়ক হবে।

তিনি বেছে নিয়েছিলেন একটি ক্ষুদে নেমাটোড বা পরজীবী কৃমিজাতীয় পোকা যার নাম সাইনোহাবডাইটিস এলিগ্যান্স - সংক্ষেপে সি এলিগ্যান।

এর গায়ের চামড়া একেবারে স্বচ্ছ - তাই একে মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে জীবিত অবস্থাতেই তার দেহকোষগুলো কিভাবে কাজ করে তার প্রক্রিয়া সরাসরি দেখা সম্ভব। এর পর থেকে মানুষের দেহ কিভাবে কাজ করে তার সম্পর্কে বহু রকমের আবিষ্কারের কেন্দ্রে ছিল এই পোকাটি।

সিডনি ব্রেনারের সহকর্মী কয়েকজনের সাথে কথা বলেছেন সু আর্মস্ট্রং, যা নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্ব।

জীববিজ্ঞানকে বাস্তবে ঘটতে দেখা:

সিডনি ব্রেনার বলেছিলেন, "আমার দরকার ছিল এমন একটি প্রাণী -যার ওপর আমি জেনেটিকসের আসল গবেষণাগুলো করতে পারবো। এ প্রাণীটিকে হতে হবে ক্ষুদ্র - যাকে আমি ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে বসাতে পারবো। বেশ কিছু প্রাণীর কথা আমি ভাবলাম, শেষ পর্যন্ত বেছে নিলাম নেমাটোড জাতীয় পোকা । শুরু করে দিলাম কাজ।"

গর্ডন লিস্কো হচ্ছেন ক্যালিফোর্নিয়ায় মানুষের বার্ধক্য বিষয়ে গবেষণার জন্য যে বাক ইনস্টিটিউট - তার ভাইস প্রেসিডেন্ট।

তিনি বলছেন, পোকাদের জগতে সিডনি ব্রেনার ছিলেন ঈশ্বরের মত। খুব জটিল জীববৈজ্ঞানিক কাজের জন্য খুব সরল একটি প্রাণী বেছে নিয়েছিলেন তিনি।

"এটা ছিল একজন প্রতিভাবানের কাজ, খুব বিচক্ষণ এক নির্বাচন। এই পোকাটার মধ্যে যা আছে তাকে বলা যায় মৌলিক জীববিজ্ঞান, কিন্তু সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হলো একে কিভাবে একে মানুষের রোগব্যাধিগুলোর প্রকৃতিকে বোঝার জন্য কাজে লাগানো হয়েছে।"

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের জিনোম সায়েন্সের অধ্যাপক। তিনি উনিশশ আশির দশকে যুক্তরাজ্যে ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ড, ব্রেনারের ল্যাবরেটরিতে যোগ দিয়েছিলেন।

বব ওয়াটারস্টোন বলছেন, "একটা প্রাণী বা অর্গ্যানিজম হিসেবে এই সি, এলিগ্যান্স সত্যি দুর্দান্ত। এর অনেক কারণ আছে। যেমন - পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় এর দেহকোষের সংখ্যা ১ হাজারেরও কম। আমরা জানি যে এই কোষগুলো কি, এরা কি কাজ করে। তার ওপর এটা খুবই ছোট । ফলে আপনি অনেকগুলো পোকা পরীক্ষা করতে পারেন, যেটা জেনেটিকসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সিডনি বলতেন, এর ফলে আপনি অনেক বিরল জেনেটিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পারেন - যা একটা রাইনো বা গণ্ডারের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।"

মানব জিনোম প্রকল্পে তার কাজের জন্য বব ওয়াটারস্টোন বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু সেই বিরাট কাজের প্রস্তুতি হিসেবে - তিনি একটি ছোট দলের অংশ হয়েছিলেন যাদের কাজ ছিল সি এলিগ্যানের জিনোম মানচিত্র তৈরি করা। এটিই হচ্ছে প্রথম প্রাণী যার জিনোমের সম্পূর্ণ সিকোয়েন্স তৈরি হযেছিল।

"আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলাম যে তখনকার প্রযুক্তি ব্যবহার করে সি এলিগ্যানের মত একটা ক্ষুদ্র প্রাণীর জিনোম সিকোয়েন্স তৈরি করা যায় কিনা । তার পর সেটাকে সম্প্রসারিত করে হয়তো পূর্ণ মানব জিনোমের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়।"

এখন আমরা জানি যে - এই চিন্তা পরবর্তীকালে সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। এ নিয়ে প্রথমে যে সংশয় ছিল তা কেটে গেল সি এলিগ্যানের জিনোম সিকোয়েন্স তৈরির পর।

দেখা গেল - এটা এত রকমের কাজে লেগে যাচ্ছে যা আগে কেউ কল্পনাই করেননি, বলছিলেন গর্ডন লিস্কো।

"মৌলিক জীববৈজ্ঞানিক দিক থেকে - সি এলিগ্যান্সের সাথে আসলে মানুষের অনেক মিল আছে। সিকোয়েন্স করার পর আমরা দেখলাম - যেসব মানুষের বিভিন্ন রোগব্যাধির সাথে যেসব জিন সংশ্লিষ্ট - তার দুই-তৃতীয়াংশই সি এলিগ্যান্সের মধ্যে আছে। সেকারণে মানুষের রোগ সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ জীববৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা আপনি এই পোকাটি দিয়েই করতে পারছেন।"

প্রাণীর আয়ু, বার্ধক্য আর ক্যান্সারের মত রোগ:

১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যে বিজ্ঞানীরা মিউট্যান্ট পোকা নিয়ে কাজ করছিলেন - তারা দৈবক্রমে আবিষ্কার করলেন যে সি এলিগ্যানের একটিমাত্র জিনের মিউটেশনের ফলে পোকাটির জীবনকাল ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।

পাঁচ বছর পরে এই পোকাটি সংবাদপত্রের শিরোনামে পরিণত হলো। কারণ তখন আরেকটি জিনের মিউটেশন খুঁজে পাওয়া গেল - যার কারণে সি এলিগ্যানের জীবনকাল ১০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। শুধু তাই নয় পোকাটি তার জীবনের শেষ পর্যন্ত সুস্থসবল ছিল বলেও দেখা গেল।

লিস্কো বলছেন, "আমরা মনে করেছিলাম মানুষের জীবনকাল মোটামুটি নির্দিষ্ট। কিন্তু এই পোকাটিকে পরীক্ষা করে আমরা দেখলাম যে একটা প্রাণীর জীবনকাল বা আয়ু জিনিসটাকে আসলে পরিবর্তন করা সম্ভব। একে দশগুণ বাড়ানো যায় - যা প্রায় অকল্পনীয় ব্যাপার। এবং ব্যাপারটাকে যদি আণবিক স্তরে বা কোষের স্তরে বিবেচনা করেন - তাহলে দেখা যায়, এই যে পোকার আয়ু ১০-২০ গুণ বাড়ানোর প্রক্রিয়া - তার সাথে মানুষের বার্ধক্যের প্রক্রিয়ার অনেক মিল আছে।"

দেহকোষের "আত্মহত্যা":

দেহের কোষও যে আত্মহত্যা করে - তা আবিষ্কার করেই সিডনি ব্রেনার এবং তার আরো দুজন সহকর্মী ২০০২ সালে নোবেল পুরস্কার পান।

সেল সুইসাইড বা দেহকোষের আত্মহত্যার প্রক্রিয়াটি ঘটে - মাতৃগর্ভে থাকার সময় মানুষের দেহের আকৃতি গঠনের সময়। যখন তার হাত ও পায়ের আঙুল, দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ এবং মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ তৈরি হয় ।

এমনকি মহাশূন্যের চরম পরিবেশেও মধ্যে দেহকোষ কিভাবে কাজ করে তা জানার ক্ষেত্রেও সি এলিগ্যান ব্যবহৃত হয়েছে।

লিস্কো বলছেন, "মহাশূন্যে স্পেস শাটলের মধ্যেও জীববৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালাতে সি এলিগ্যান ব্যবহৃত হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম প্রাণী হিসেবে মহাশূন্যে তা প্রজনন এবং বংশবৃদ্ধি করতেও সক্ষম হয়েছে।"

২০০৩ সালের ফেব্রয়ারিতে স্পেস শাটল কলম্বিয়া পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় বিস্ফোরণের ধ্বংস হয়ে যায়। নভোচারীদের সবাই নিহত হন। কিন্তু বেঁচে ছিল সি এলিগ্যানগুলো।

গর্ডন লিস্কোবলছিলেণ, "বিস্ফোরণের পর সি এলিগ্যান ভর্তি পাত্রগুলোর কয়েকটি মাটিতে খুঁজে পাওয়া যায়। সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায়, পোকাগুলো জীবিত আছে। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার যে ওই বিস্ফোরণের পরও তারা টিকে থাকতে পেরেছে।"

লিস্কোর কথায় - সিডনি ব্রেনার নিশ্চয়ই এগুলো জানতে পারলে খুবই গর্বিত হতেন।

সান নিউজ/এমএম

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সংহতি জানালো মুক্তিজোট

গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে সোমবার (৭ এপ্রিল) বিশ্বব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান জ...

কুমিল্লায় গোমতী নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলন: ৬ ট্রাক জব্দ, ১ জনের জেল

কুমিল্লার গোমতী নদীর চরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে ০৬...

সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে ছাত্রদল নেতাসহ আহত চার

বগুড়ার রেলওয়ে এলাকায় ছাত্রদল নেতার ওপর সন্ত্রাসী হ...

ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে লক্ষ্মীপুরে হরতাল অবরোধ

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান ধ্বংসযজ্ঞ...

ইসরায়েল নিশ্চিহ্নে হামাস ইরানের কাছে ৫০০ মিলিয়ন ডলার চেয়েছিল!

ইরান ও হামাস নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন ইসরায়েলে...

ঈদে কে কোন আসনে সক্রিয় ছিলেন এনসিপি নেতারা

পবিত্র ঈদুল ফিতরে অন্তত ৪০টি নির্বাচনী আসনে জনসংযো...

খুলনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

‘জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত&rsquo...

ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে লক্ষ্মীপুরে হরতাল অবরোধ

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর চলমান ধ্বংসযজ্ঞ...

গৃহবধূকে ধর্ষণচেষ্টা; ওসি-এসআইসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা

সুনির্দিষ্ট কোন মামলা ছাড়াই এক গৃহবধূকে (২৫) আটক করে ধর্ষণচেষ্টা ও চাঁদাবাজির...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা