ফিচার ডেস্ক: অনুভূতি সহজভাবে প্রকাশের মাধ্যমে আত্ম-সচেতনতা বৃদ্ধিও সম্ভব, যা দীর্ঘমেয়াদে মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতেও সহায়তা করে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় এমন দেখা যায়। তবে কোনো রকমে লিখে ফেললেই তা অর্জিত হয় না; বরং এ জন্য লেখা হতে হবে আত্ম-সচেতনতাধর্মী।
স্পষ্ট ভাষায়, জোরালো শব্দে অনুভূতি ফুটিয়ে তোলার ওপর জোর দিতেন প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। মানুষের মনস্তত্ত্ব কিংবা মনোবিজ্ঞান হেমিংওয়ে কতটা বুঝতেন জানা নেই। তবে লেখার এমন ধরন যে মানসিক প্রশান্তি দিতে পারে, তা নিশ্চিত করেছেন গবেষকরা।
তারা জানিয়েছেন, মনকে ব্যথাতুর করে তোলার যত অনুভূতি, সেগুলো লিখে ফেললে তা আখেরে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণ ও সংবাদকেন্দ্রিক সাময়িকী দ্য কনজারেভেশনের একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে এমন তথ্য।
এতে জানানো হয়েছে, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর লেখালেখির ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে হয়েছে দুই শতাধিক গবেষণা। তবে লেখালেখির মনস্তাত্ত্বিক উপযোগিতা বেশিরভাগ মানুষের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ বলে জানা গেলেও কেন বা কীভাবে এটি সাহায্য করে, সে বিষয়ে একমত নন গবেষকরা।
একটি তত্ত্বে বলা হয়েছে, মনে মনে সবকিছু চেপে যাওয়ার অভ্যাস মানসিক অশান্তির কারণ। এ ক্ষেত্রে সেসব লিখে ফেলা অনুভূতি প্রকাশের সবচেয়ে নিরাপদ ও সুরক্ষিত মাধ্যম হতে পারে।
সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা যায়, অনুভূতি সহজভাবে প্রকাশের মাধ্যমে আত্ম-সচেতনতা বৃদ্ধি সম্ভব, যা দীর্ঘমেয়াদে মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতেও সহযোগিতা করে। তবে কোনো রকমে লিখে ফেললেই তা অর্জিত হয় না; বরং এ জন্য লেখা হতে হবে আত্ম-সচেতনতাধর্মী।
আত্ম-সচেতনতাধর্মী লেখা ব্যক্তিকে নিজের প্রতি মনোযোগী করে। এর মাধ্যমে তার আচরণ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অনুভূতি, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, স্পৃহাসহ সব ধরনের অনুভূতি সজাগ হয়ে ওঠে।
গবেষণায় দেখা যায়, আত্ম-সচেতন হয়ে ওঠার মাধ্যমে ব্যক্তি নানাভাবে উপকৃত হন। এটি আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, অন্যকে সহজে গ্রহণে উৎসাহিত করে। এটি আমাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের চর্চায় সাহায্য করে এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনে ভালো সিদ্ধান্ত নিতেও সহযোগিতা করে।
আত্ম-সচেতনতা কর্মক্ষেত্রে সন্তোষ তৈরি করে এবং কার্যকর নেতৃত্বদানের পথও খুলে দেয়। আত্ম-সচেতনতা মানবজীবনের অনেক রং ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। এটি চর্চার মাধ্যমে আত্মোন্নয়ন সম্ভব।
বিশেষ করে প্রতিদিন এ চর্চা সম্ভব বলে লেখালেখির মাধ্যমে আত্ম-সচেতনতা তৈরি একই সঙ্গে কার্যকর ও সহজ পদ্ধতি। নিজেদের পুরোনো লেখা পড়ে দেখার মাধ্যমে নিজের চিন্তা, অনুভূতি, আচরণ ও বিশ্বাসের গভীরে প্রবেশ করাও সহজ। আত্ম-সচেতনতা তথা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী তিন ধরনের লেখার ওপর জোর দিচ্ছেন গবেষকরা।
১. স্পষ্ট লেখা
মনকে সুস্থ রাখার চেষ্টা হিসেবে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই মানসিক চাপের জন্য দায়ী ঘটনার বিষয়ে নিজেদের চিন্তা ও অনুভূতি স্পষ্ট করে লেখার পরামর্শ দেন। ব্যক্তির জন্য সংবেদনশীল, এমন বিষয়ের প্রতি অনুভূতির স্বচ্ছতা প্রকাশে সাহায্য করে এ ধরনের লেখা, যা সাধারণভাবে খানিকটা কঠিন।
গবেষণায় দেখা যায়, আত্ম-সচেতনতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট লেখা বিষণ্নতার উপসর্গ, দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ কমিয়ে আনে।
২. চিন্তাশীল লেখা
চিন্তাশীল লেখার ব্যবহার সাধারণত দেখা যায় কর্মক্ষেত্রে। বিশেষ করে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক, মনোবিজ্ঞানী ও সমাজকর্মীদের পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে তাদের এ ধরনের লেখার সাহায্য নিতে বলা হয়।
চিন্তাশীল লেখা ব্যক্তিকে নিজের বিশ্বাস ও কর্ম বিশ্লেষণ করে দেখার সুযোগ করে দেয়। নতুন কিছু শেখা ও আত্মোন্নয়নের দারুণ উপায় এটি।
চিন্তাশীলভাবে লিখতে হলে ব্যক্তিকে নিজের প্রতি কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে হয়। কৌতুহলী, বিশ্লেষণধর্মী ও উদার প্রশ্নের উত্তরও ভেবে বের করতে হয় তাকেই। এতে নিজের অভিজ্ঞতা ও অন্যদের সঙ্গে তার অনুভূতির আদান-প্রদানের মাধ্যমে তিনি শেখেন এবং তার আত্ম-সচেতনতা বাড়ে।
এ ধরনের চর্চা কর্মক্ষেত্রের পাশাপাশি ব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নয়নেও সাহায্য করে, যা মানসিক সুস্বাস্থ্যের অন্যতম নির্দেশক।
৩. সৃজনশীল লেখা
কবিতা, ছোট গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি সৃজনশীল লেখার অন্যতম উদাহরণ। এ ধরনের লেখায় ব্যক্তির কল্পনাশক্তি ও স্মৃতিশক্তি বাড়ে।
নানা রকম উপমা ও রূপক শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে ভিন্ন রূপে অর্থবহ করে তোলা হয় লেখাকে। ফলে চিন্তা, অনুভূতি, বুদ্ধি, ধারণা ও বিশ্বাসকে নতুনভাবে আবিষ্কার করার দারুণ একটি উপায় সৃজনশীল লেখা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে নিজের উদ্বেগ প্রকাশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী কিংবা বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক নিয়ে নিজের বিশ্বাস তুলে ধরতে শিশুসাহিত্যের আশ্রয় নেয়া হয়। অনিদ্রা সম্পর্কে বোঝাতে প্যাঁচার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি কবিতাও লিখে ফেলা যায়।
অনুশোচনার মতো কঠিন অভিজ্ঞতা লেখার মাধ্যমে অন্যদের সহজে বোঝানো সম্ভব। কারণ এ ধরনের অনুভূতি মৌখিকভাবে বোঝানো বা বোঝা অনেকের কাছেই বেশ কঠিন।
সৃজনশীল লেখা মানুষকে শব্দ বেছে নিতে, উপমা আর ছবি ব্যবহারে উৎসাহ দেয়। এতে বার্তা প্রদান অনেক সহজ হয়ে যায়। এভাবে সৃজনশীল সিদ্ধান্ত-গ্রহণ ক্ষমতা ব্যক্তির আত্ম-সচেতনতা ও আত্মসম্মান জোরালো করে, যা মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য ভীষণ দরকার।
মানসিক সুস্বাস্থ্যের প্রথম শর্তই আত্ম-সচেতনতা। আর এটি অর্জনে শুরুর ধাপ হতে পারে লেখালেখি। প্রতিদিন এ জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় বের করা হতে পারে নিজের জন্য বড় সুযোগ।
সাননিউজ/এএসএম