আবদুল্লাহ আল ইমরান
এই খালি হাতিরপুল যাবা? পল্টন পুলিশ বক্সের সামনে রিকশাটা ডাকলাম। এইডা কি মোহাম্মদপুর যাইতে পড়বো?
ফিরতি এমন প্রশ্নে অবাক হয়ে দেখলাম উদভ্রান্ত চেহারার একটা ছেলে। বয়স আঠারো কি বিশ। ক্লান্তিতে চুপসে যাওয়া মুখ। বুঝলাম নতুন।
সাধারণত এমন রিকশা এড়িয়ে চলি। চেনে না বিধায় সামান্য পথও এদের কাছে বিস্তর মনে হয়। ভাড়া নিয়ে ক্যাচাল বাঁধে। এছাড়াও রিকশায় উঠলেই আমার মাথায় রাজ্যের গল্প ডালপালা মেলে, অসংখ্য চরিত্র হাজির হয় ভাবনায়। এমন ঘোরের মধ্যে ডানে-বায়ে নির্দেশনা দেওয়া দুরহ কাজ।
রাত বাড়ছে। রিকশাই জুটবে না শেষে। লাফ দিয়ে তাই রিকশায় চড়লাম। বললাম, ‘আমাকে নামিয়ে তুমি অনায়াসে মোহাম্মদপুর যেতে পারবে। চলো।’
রিকশা চলছে।
তরতর করে পেরিয়ে যাচ্ছি সচিবালয়, প্রেসক্লাব, কদম ফোয়ারা। চারপাশের মানুষের মধ্যে নিজেকে খোঁজার স্বভাব আমার। ফুটপাতের পঙ্গু ভিক্ষুক কিংবা শ্রম বিক্রির আশায় করুণ তাকিয়ে থাকা বৃদ্ধের অবস্থানে মুহুর্তেই নিজেকে বসাই। নতুন বোধের জন্ম হয়।
আজও তাই। ছেলেটার যায়গায় নিজেকে বসালাম। গল্প জুড়ে দিয়ে জানলাম, নাম আবদুল্লাহ।
- রিকশা চালাও কয়দিন?
- আইজ লইয়া তিনদিন।
- পালাইছ?
- উঁহু, ঘটনা ভিন্ন।
- কি ঘটনা, বলা যায়?
- মাস দুই হইল ড্রাইভারি শিহি। লাইসেন্সের লাইগ্যা বাড়ি থেইকা পাঁচ হাজার টাহা আনছিলাম। আওনের কালে হেয়া চুরি গ্যাছে। বাড়িতে কইলে বিশ্বাস করবে না। ভাববে ভাইঙ্গা ফেলাইছি। টাহা যোগাইতে তাই রিশকা লইছি।
- আহারে! তিনদিনে কত জমাইলা?
- টাহা জমাইন্যা কঠিন। খাইয়া-লইয়া থাহে না কিছু। অভ্যাস নাই তো, এট্টু পর পর খালি খিদা লাগে। সব মিললা তাও শ’ পাঁচেক হইবে।
বেহিসেবি আমার হঠাৎ পাঁচ হাজার টাকাকে অনেক বড় একটা সংখ্যা মনে হয়। এতো বেশি বড় যে, রোদ বৃষ্টিতে ভিজে, ঘেমে নেয়েও সে টাকা যোগাতে মাসের পর মাস লাগবে!
মন খারপ হয়। খুব মন খারাপ হয়। কথা ঘুরাই।
- প্রেম-ট্রেম করো?
- করতাম।
- করতাম মানে?
- ছাইড়া দিছি।
- ওমা, কেন?
- মোর কোন ভবিষ্যৎ আছে? রিশকা-রুশকা চালাই। মাইয়াডা ভালো। ওর জীবনডা নষ্ট করতে চাই না। তাই দূরে দূরে সইরা রই। কল দিলেও ধরি না।
শেষের দিকে আবদুল্লার কণ্ঠটা অন্যরকম ঠেকলো। একটু কী কাঁপলো? হবে হয়তো। খুব আপন মানুষকে ইচ্ছাকৃত দূরে সরিয়ে রাখার চেয়ে কষ্টের কাজ আর হয় না। আমি আর কথা বাড়ালাম না। নীরবতা ভাঙল আবদুল্লাহ। বললো, ‘আমার তিনডা স্বপ্ন আছে জানেন।’
বলি, ‘কি স্বপ্ন?’
- দাদা-দাদির কবরডা বান্দামু। মরার আগে বাপ-মায়রে হজ্বে পাঠামু। আর কাঠের ঘরডারে পাকা করমু।
আবদুল্লাহর মুখটা দেখতে পাচ্ছি না।
হাঁপাতে হাঁপাতে সে রিক্সা টানছে। ঘামে ভিজে যাচ্ছে লিকলিকে শরীর। মাত্র কয়টা হাজার টাকার জন্য কী অমানুষিক পরিশ্রমই না করছে ছেলেটা। অথচ বুকের গহীণে বিপুল মমতায় লালন করে চলছে অমূল্য সব স্বপ্ন, কী যে বিশুদ্ধ তার অঙ্গীকার!
এই শহরে নিত্য হাজার স্বপ্ন ভাঙ্গে।
যাপিত জীবনের কঠিন কঠোর ছোবলে বেদনাহত হয় কত-শত প্রাণ! আবার এই শহরেই এমন অসংখ্য আবদুল্লাহর বাস। যাদের তিনবেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই কিন্তু আছে বুক ভরা স্বপ্নের চাষাবাদ। সেই স্বপ্ন পূরণে বেঁচে থাকে তারা। প্রত্যুষে সম্ভাবনার সূর্য দেখবে বলে গভীর আবেগে ঘুমুতে যায় প্রতি রাতে। এ শহরের আবদুল্লাহরা ভালো থাকুক, ভালো থাকুক তাদের কাগজী লেবুর সুবাসমাখা লাল-নীল স্বপ্নেরাও।
লেখক-সাংবাদিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক
সান নিউজ/আরএস