তারেক সালমান: সময়টা ১৯৭১। স্বাধীনতার গর্ভ যন্ত্রনা নিয়ে উত্তাল বাংলাদেশ। রাজপথ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে। যুদ্ধের ডামাডোলে কাতারে কাতারে ভিটেমাটি ছেড়ে জীবন বাঁচাতে মানুষ যাচ্ছেন এদিক-সেদিক। কেউ কেউ কাঁটাতার পেরিয়ে চলে যাচ্ছেন ভারতে। দু‘দেশের সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠছে উদ্বাস্তুশিবির। নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কোনোরকমে বেঁচে থাকতে হচ্ছে তাদের।
স্বাভাবিকভাবেই, যুদ্ধের অনুসঙ্গ হয়ে হাজির মহামারীও। কলেরা আর ডায়রিয়ায় প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত। ডায়রিয়ার চিকিৎসা বলতে তখনও শুধু ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন। অথচ মহামারীর প্রাদুর্ভাব যত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, স্যালাইনের জোগান সেই তুলনায় খুবই কম। আর এর মধ্যেই ঘটে গেল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। ব্রিটেনের মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যাসেন্টে’র মতে যা বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। আর সেই আবিষ্কারের পিছনে ছিলেন একজন জন্মগত বাংলাদেশী চিকিৎসক। নাম ডা. রফিকুল ইসলাম।
ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন যখন প্রায় পাওয়াই যাচ্ছে না, তখন রীতিমতো ঝুঁকি নিয়ে একটি পরীক্ষা করে ফেললেন ডা. রফিকুল ইসলাম। পাকিস্তান-সিয়েটো কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষক ডা. রফিকুল নিজেও মুক্তিযুদ্ধের একজন সক্রিয় সৈনিক। সেই সূত্রেই জড়িয়ে পড়া কলেরা দুর্গত মানুষদের সঙ্গে। মুমূর্ষু মানুষদের বাঁচাতে বেছে নিলেন একটি ঘরোয়া পদ্ধতি। একগ্লাস পানিতে একমুঠো গুড় আর একচিমটি নুন মিশিয়ে খাইয়ে দিলেন রোগীদের। শরীর থেকে ক্রমাগত তরল পদার্থ বেরিয়ে যাওয়ায় যাদের অবস্থা প্রায় মরণাপন্ন হয়ে উঠেছিল, তারা সেরে উঠতে থাকলেন ডা. রফিকুল ইসলামের চিকিৎসায়।
ডা. রফিকুলের সঙ্গে একই গবেষণাগারে কাজ করতেন ডেভিড নেলিন এবং ক্যাস নামে দুজন ইউরোপীয় বিজ্ঞানী। রফিকুলের পরীক্ষায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন তারাও। আর শরীরী বিজ্ঞানের দীর্ঘদিনের একটা অমীমাংসিত রহস্য পরিষ্কার হয়ে যায়। পিএসসিআরএ ‘র পরীক্ষাগারেই তৈরি হয় প্রথম পরিমিত ওরাল স্যালাইন বা ওরস্যালাইন। সারা বিশ্বে কলেরা ও ডাইরিয়ার চিকিৎসায় ব্যাপক ব্যবহৃত হয় এই দ্রবণ। এমনকি ডিহাইড্রেশনের প্রাথমিক চিকিৎসা হিসাবে ওরাল স্যালাইনের ব্যবহার সর্বত্র স্বীকৃত। ১৯৮০ সালে এই আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।
রফিকুল ইসলাম ১৯৩৬ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির (বর্তমান বাংলাদেশ) কুমিল্লার (বর্তমানে নাঙ্গলকোট) রায়কোট উত্তর ইউনিয়ের মালিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি ব্রিটেনে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঔষধ এবং স্বাস্থ্যবিধি (ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও হাইজিন) বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন।
দেশে ফেরেন যখন, তখন মুক্তিযুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠেছে। গবেষণার পাশাপাশি চলে স্বাধীনতা আন্দোলনের কাজ। স্বাধীনতার পর বন্ধ হয়ে যায় তাঁর গবেষণার সংস্থা পিএসসিআরএল। কিছুদিনের মধ্যেই নতুন নামে গড়ে ওঠে ইন্টারন্যাশানাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ যা দেশ-বিদেশে বর্তমানে আইসিডিডিআর-বি নামে সমধিক পরিচিত। ২০০০ সাল পর্যন্ত এই সংস্থাতেই কাজ করে গিয়েছেন তিনি। তাঁর গবেষণার সূত্র ধরেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন অসংখ্য মানুষ। অবশ্য শেষ বয়সে তাঁকেও কম রোগভোগের শিকার হতে হয়নি। ২০১৮ সালের ৬ মার্চ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ‘বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারে’র এই পথিকৃৎ।
ডা. রফিকুল ইসলামের আবিষ্কার সারা পৃথিবীতে স্বীকৃতি পেয়েছে। অন্ত্রের বিশেষ কোষের ভিতর দিয়ে কীভাবে জলীয় পদার্থের বিনিময় হয়, কীভাবেই বা সেই পদ্ধতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কার্বো-হাইড্রেট–এসবই জানা সম্ভব হয়েছিল তাঁর আবিষ্কারের মাধ্যমে। আর ডাইরিয়ার জন্য আমাদের ঘরোয়া ওষুধ ‘নুন-চিনি’বা ‘গুড়-লবণ’ও আজ তাঁর দৌলতেই চিকিৎসাশাস্ত্রে স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশ তাঁকে কতটুকুই বা মনে রেখেছে?
ডা. রফিকুল ইসলাম ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। ২০১৮ সালের ৬ই মার্চ তিনি ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ৬ই মার্চ মরহুমের গ্রামের বাড়ী মালিপাড়ায় বিশাল জানাজা শেষে পিতামাতার কবরের পাশে চির শায়িত হন। অনেকটা নীরবে চলে গেলেন তিনি। অথচ দেশের কাছ থেকে আরও সম্মান নিশ্চয়ই প্রাপ্য ছিল তাঁর।
সাননিউজ/টিএস