শরীফ ইকবাল রাসেল, নরসিংদী প্রতিনিধি : প্রাচ্যের ম্যানচেস্টার খ্যাত নরসিংদীর বাবুর হাট। দেশের কাপড়ের চাহিদার মোট ৭০ ভাগ পূরণ হয়ে থাকে এই বাবুর হাটের কাপড় দিয়ে। আর এ বাজারের ব্যবসায়ীরা বছরের ১১ মাস যে পরিমাণ কাপড় বিক্রি করে থাকে তার কয়েকগুণ কাপড় বিক্রি করে থাকে শুধুমাত্র এই রমজান মাসেই। সেই হিসেবে শুধুমাত্র ঈদেই দুহাজার কোটি টাকার কাপড় বিক্রি হয়ে থাকে।
কিন্তু লকডাউনের কারণে দুবছর ধরে এই বাজার ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। কাপড় বিক্রি করতে না পেরে একদিকে দোকান ভাড়া, অন্যদিকে কারখানার শ্রমিকদের বেতনভাতা, বিদ্যুৎবিলসহ বিভিন্ন খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। যার ফলে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা অনেকটা ব্যবসা ঘুচিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন। অপর দিকে মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের মালিকরা কোন রকমে ভর্তুকি দিয়ে টিকে আছেন ভবিষ্যতের আশায়।
নরসিংদী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার উৎপাদিত তাঁতশিল্পের পণ্যগুলো এখানেই বিক্রি হয়ে থাকে। যার ফলে এই বাজারে বিক্রি হয় থান কাপড়, পপলিন কাপড়, ভয়েল কাপড়, সুতি কাপড়, শাড়ি, থ্রি-পিস। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় উৎপাদিত নাইট কুইন, দেশীয় জর্জেট, লেজার জর্জেট, জাপানি সিল্ক, টাঙ্গাইলের শাড়ি, জামদানি, কাতানসহ বিভিন্ন প্রকারের কাপড়ের সম্ভারে বাবুরহাট হয়ে উঠেছে দেশের অন্যতম কাপড়ের বাজার।
আর এই সেখেরচর, বাবুরহাটকে কেন্দ্র করে ছোট বড় প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি কারখানা এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে। এভাবে লকডাউনের কারণে গত বছর ব্যাংক লোন নিয়ে ও ভর্তুকি দিয়ে কোন রকমে তাদের কারখনাকে ধরে রেখেছিল এবছরের আশায়, কিন্তু এবারও আশার মুখে গুড়েবালি। করোনার থাবায় এবারও বিপর্যস্ত প্রাচ্যের ম্যানচেস্টারখ্যাত এই বাবুরহাট। গত বছর অনলাইনের মাধ্যমে কিছু কাপড় বিক্রি করতে পারলেও এবার লকডাউন ও করোনার মাত্রা তীব্র হওয়ায় একদিকে রাস্তায় যানবাহন কম অন্যদিকে অনলাইনেও খুব বেশি সারা না পাওয়ায় ব্যবসায়ীরা হতাশ।
সরেজমিনে দেখা যায়, চলমান লকডাউনের ফলে বাবুরহাট বাজার নিরব-নিস্তব্ধ ও জনমানবহীন হয়ে পড়েছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা, নেই কোন শোরগোল, বন্ধ রয়েছে হাটের সকল দোকানপাট। বাজারের অলি, গলি পথঘাট পুরোটাই ফাঁকা। দু একটি দোকান খোলা তাকলেও ক্রেতা নেই। প্রতিটি দোকানের শার্টারে ঝুলছে বড় বড় তালা। অনেক দোকানি হাটে আসলেও দোকান খুলতে দেখা যায়নি। মহাসড়কের পাশে এখন আর নেই সারি সারি কাপড়ের ট্রাক।
বাবুরহাটে ছোট-বড় প্রায় ৩ হাজারের অধিক বিভিন্ন ধরনের পাইকারি কাপড়ের দোকান রয়েছে। দেশের অন্যতম এই বাজারে শুধুমাত্র পাইকারি হিসেবে সপ্তাহে বিক্রি হয়ে থাকে প্রায় ৫ থেকে ৭শ কোটি টাকার কাপড়।
ঈদ মৌসুমে বিভিন্ন জেলার পাইকারি ক্রেতা-বিক্রেতা মিলিয়ে ৫ থেকে ৭ লাখ লোকের জনসমাগম ঘটে বাবুরহাটে।
শায়লা থ্রি পিসের মালিক আওলাদ হোসেন জানান, লকডাউনের কারণে বাস ও ট্রেনসহ গণপরিবহনগুলোর চলাচল বন্ধ থাকায় আশপাশের জেলাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে হাটে কোন পাইকারি আসতে পারছেনা। এ অবস্থায় কেউ কেউ অনলাইনে অর্ডার দিলেও যানবাহনের কারণে মাল পৌঁছাতে সমস্যা হচ্ছে। আমরা এই ঈদকে কেন্দ্র করেই যা বিক্রি করি তা দিয়েই বলতে গেলে বাকি ১১মাস পার করে থাকি।
তার মতো আরো ব্যবসায়ীদের একই দাবি, বছরের এগারোটি মাস লাভ-লোকসানের মধ্যদিয়ে আমরা ব্যবসা পরিচালনা করলেও অপেক্ষায় থাকি ঈদ মৌসুমের এই একটি মাসের জন্য। কিন্তু দেশের মহামারি করোনা পরিস্থিতির জন্য সরকার ঘোষিত লকডাউনে আমাদের সব আশা ভেস্তে গেছে। বর্তমানে আমাদের জীবন জীবিকাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নরসিংদী চেম্বর অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির প্রেসিডেন্ট ও সোনালী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচারক আলী হোসেন শিশির জানান, এই বাবুর হাটকে কেন্দ্র করে কয়েক লাখ লোকের রোজগার। শুধুমাত্র এই ঈদকে কেন্দ্র করেই প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার কাপড় কেনাবেচা হয়ে থাকে। যা থেকে গতবছরও বঞ্চিত হতে হয়েছে। এবারও সেই একই অবস্থা। শিল্পকে বাঁচাতে সরকারকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
সান নিউজ/আরএস