আব্দুস সালাম, সুনামগঞ্জ :
‘‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দী হইয়ারে-কান্দে হাসন রাজার মন ময়নারে, লোকে বলে বলে রে ঘর-বাড়ি ভালা নায় আমার, কি ঘর বানাইব আমি শূন্যেরও মাঝার,’’ এমন সব কালজয়ী গানের শ্রষ্টা মরমী কবি হাসন রাজা। সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে লক্ষণশ্রী পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে বিখ্যাত মরমী সাধক হাসন রাজার জন্মভিটা। যা এখন অযত্নে-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে।
নেই সে জমিদার, নেই জমিদারি, নেই হাতি-ঘোড়া, পাইক-পেয়াদা। আছে শুধু জমিদারের রেখে যাওয়া এই স্থাপত্য। স্মৃতি ধরে রাখতে উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউ। বাড়িটি হাসনের শেষ স্মৃতি হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে আজও পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়।
এই মরমী সাধকের মৃত্যুর ৯৭ বছর পর তার জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রশাসন বা পরিবারের পক্ষ থেকে করা হয় না কোনো আয়োজন। অনেকটাই নিরবে পার হয়ে যায় দিনগুলি।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, যে বাড়ীতে হাসন রাজা বসবাস করতেন এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পরে রয়েছে। নেই কোনো মানুষের বসবাস, ঘর থাকে তালাবদ্ধ। এই গুণী সাধকের বাড়িটি পড়ে আছে অবহেলায়। পৌরশহরের ভিতরে অবস্থিত হাসন রাজার বাড়ি ‘সাহেব বাড়ি’ নামেই সবার কাছে পরিচিত।
বাড়িটি ঘিরে রয়েছে কয়েক’শ বছরের ইতিহাস। রয়েছে একটি হাসন রাজা মিউজিয়াম।
স্থানীয়রা জানান, পরিবার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংরক্ষণ করার নেই কোনো উদ্যোগ। হলহলিয়া জমিদার বাড়ি, গৌরারং জমিদার বাড়ি, সুখাইড় জমিদার বাড়িসহ জেলার বিভিন্ন জমিদার বাড়ি সংরক্ষণ করা হলেও হাসন রাজার কোনো স্থাপনা বা স্থাপত্য সংরক্ষণে নেই কোনো উদ্যোগ।
এছাড়া প্রশাসনের আয়োজনে জেলার লোককবি বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম, বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত, মরমী গীতিকবি দুর্বিন শাহ’র জন্ম-মৃত্যুবাষির্কী সরকারি পৃষ্টপোষকতায় পালন করা হলেও কোন এক কারণে পালন করা হয়না এই মরমী সাধক হাসন রাজার জন্ম বা মৃত্যুবাষির্কী ।
পর্যটকরা মনে করেন, প্রত্নতাত্তিক বিভাগের হস্তক্ষেপে হয়তো জমিদার বাড়িটিও হতে পারে অন্যতম এক পর্যটন কেন্দ্র। এর রক্ষণাবেক্ষণের ফলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে তৎকালীন জমিদারদের ইতিহাস-ঐতিহ্য। হাসন রাজার অসংখ্য ভক্ত অনুরাগীরা আগ্রহ নিয়ে দেখতে এসে অনেকেই হতাশ হন।
পর্যটক মৃনাল কান্তি দাস বলেন, ‘অনেক দিন ধরে ইচ্ছে ছিলো হাসন রাজার বাড়িটি দেখার। কিন্তু এই সাধক রাজার বাড়ি এভাবে পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখে কষ্ট পেলাম।
আরেক পর্যটক সাইফুল্লাহ হাসান বলেন, ‘দেশে হাসন রাজার এতো সুনাম থাকলেও এই রাজার বসতভিটা সংরক্ষণ করা হয়নি। যে ঘরে হাসন রাজা থাকতেন এই ঘরটিকে সংরক্ষণ করে মিউজিয়াম করলে পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ানো যেতো। যে মিউজিয়ামটি আছে তা পর্যটকদের তুলনায় ছোট। আমাদের দাবি দ্রুত এই মরমী সাধকের স্মৃতি সংরক্ষণ করা হোক।
হাসন রাজার প্রপৌত্র ও হাসন রাজা পরিষদের চেয়ারম্যান সামারীন দেওয়ান বলেন,‘হাসন রাজা পরিবার তাকিয়ে থাকে প্রশাসনের দিকে আর প্রশাসন তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। এ জন্য স্থানীয় বা সরকারি পৃষ্টপোষকতায় পালিত হয় না হাসন রাজার জন্ম অথবা মৃত্যুবার্ষিকী। কিছুদিন আগে অনুষ্ঠান বিহীনভাবেই তার জন্মদিন চলে গেছে। স্পনসর পাওয়া গেলে আমরা চেষ্ঠা করি হাসন রাজা পরিষদের উদ্যোগে বড় আকারে সুনামগঞ্জের বালুর মাঠে অনুষ্ঠান করতে। আসলে হাসন রাজার বিষয়ে স্থানীয় বা সরকারি উদ্যোগ একবারে নাই বললেই চলে।
তিনি আরোও বলেন, ‘হাসন রাজার পরিবারের পক্ষ থেকে সুরমা নদীর তীঁর ঘেঁষে হাসন রাজার বাড়ীতে একটি দৃষ্টি নন্দন মিউজিয়াম, একটি সংগ্রহ শালার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে সরকারকে জানাবো। সরকার এগিয়ে আসলে এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হবে। হাসন রাজার স্থাপত্য সংরক্ষণেও দাবি জানান তিনি। এভাবে চলতে থাকলে হাসন রাজা, তার কর্ম, স্মৃতি মানুষের কাছ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন,‘গত কিছুদিন আগে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের পরিকল্পনা সচিব ও পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হাসন রাজার বাড়ি পরিদর্শন করে গেছেন। এসময় হাসন রাজার পরিবারকে বলা হয়েছে হাসন রাজাকে ধরে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে একটি হাসন রাজা সংগ্রহশালা করা হবে। যেখানে হাসন রাজার জীবন কর্ম নিয়ে গবেষণা চর্চা করা যাবে। বাড়িটি সংরক্ষণের ব্যাপারে তাদেরকে বলা হয়েছে একটি প্রস্তাবনা পাঠানোর জন্য কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো প্রস্তাবনা আমাদের কাছে আসে নি।
সান নিউজ/সালি