নিজস্ব প্রতিবেদক : ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপ থেকে সমৃদ্ধ অর্থনীতির পথে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ জুটমিলস করপোরেশন (বিজেএমসি)। প্রতিষ্ঠাকালে বিজেএমসির অধীনে ৭০টিরও বেশি পাটকল ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সরকার পরিবর্তনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধারাবাহিক লোকসানের কারণে মিল কমে দাঁড়ায় ২৫-এ।
এসব পাটকলে প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত ছিলেন। লোকসানের মুখে হঠাৎ মিল বন্ধ করে দেওয়ায় শ্রমিকরা এখন বেকার। পাটকলগুলো চালুর দাবিতে সারাদেশে আন্দোলনও করেছিলেন শ্রমিকরা। শ্রমিক পরিবারগুলো এখন অসহায় ও মানবেতর জীবনযাপন করছে। এর মধ্যে দেশে বন্ধঘোষিত রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিলগুলো ব্যক্তি বা কোম্পানি পর্যায়ে ইজারা (লিজ) দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চলতি মাসের যে কোনও সময় শুরু হবে লিজ প্রক্রিয়া।
ইতোমধ্যে পাটকলগুলো লিজ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। দ্রুত পাটকলগুলো চালু করে উৎপাদন বাড়িয়ে কর্মহীন শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে ইজারা পদ্ধতি চুড়ান্তের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করছে মন্ত্রণালয়। এর মধ্য দিয়ে অবসরকালীন শ্রমিকদের মধ্যে অভিজ্ঞ ও দক্ষদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ দেওয়া হবে।
পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় তথ্য সূত্রে জানা যায়, এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ৩টি শর্তে ইজারা দেওয়া কারখানাগুলো বাংলাদেশ জুটমিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) ব্যবস্থাপনায় থাকবে। জানা গেছে, সরকার গত ২৮ জুন বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে এসব পাটকলের ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক কর্মসূচির মাধ্যমে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে।
আরও প্রায় ১৩ হাজার ক্যাজুয়াল বা বদলি শ্রমিক এ গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের সুবিধা পাবেন না। এসব পাটকল ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত করার পর পুঞ্জীভূত লোকসান দিয়েছে ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, গত ১১ বছরে মাত্র এক বছর প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা অর্জন করতে পেরেছে।
সূত্র জানিয়েছে, সরকার প্রাথমিকভাবে পাটকলগুলো পুণরায় চালুর জন্য ৪টি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। প্রথমত, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি), দ্বিতীয়ত যৌথ উদ্যোগ, তৃতীয়ত সরকার টু সরকার (জিটুজি) এবং সর্বশেষ পরিকল্পনা ছিল ইজারা বা লিজ দেওয়া। বিশ্লেষণ শেষে লিজ দেওয়াটাকেই উপযুক্ত মনে করেছে সরকার।
তবে এ ক্ষেত্রে ৩টি শর্ত দেওয়া হয়েছে। ইজারা দেওয়া কারখানাগুলো বাংলাদেশ জুটমিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) ব্যবস্থাপনায় থাকবে। লাভ-লোকসানে কোনও অংশীদারিত্ব থাকবে না। ইজারা দেওয়ার পর সরকারের দেওয়া শর্ত পালন করছে কিনা তা তদারকি করবে বিজেএমসি। এছাড়া অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মচ্যুত শ্রমিকদের নিয়োগ দিতে বাধ্য থাকবে লিজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি। এ জন্য কঠোর নজরদারি করা হবে বলেও জানিয়েছে পাট মন্ত্রণালয়।
এদিকে পাটকলগুলো আধুনিকায়ন করে তারপর চালুর দাবি জানিয়েছে পাট-সুতা ও বস্ত্রকল শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ। তারা বলেছেন, বিশ্বব্যাপী চাহিদা পূরণ ও পাটজাত পণ্য রফতানির সুযোগ হাতছাড়া হলে তা দেশের শিল্প ও অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী হবে।
সরকারি পাটকল বন্ধ থাকলেও বেসরকারি পাটকলগুলোয় পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) করোনাকালেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি বেড়েছে ২৩ শতাংশ। যেখানে একই সময়ে পোশাক, চামড়া, চামড়াজাত পণ্যসহ অন্য অনেক খাতের রফতানি কমেছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশের শ্রমিকদের বেকারত্ব নিরসনে সরকারের আমন্ত্রণে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্রিসেন্ট ও প্লাটিনাম জুটমিল লিজ নেওয়ার জন্যও প্রাথমিকভাবে আগ্রহ দেখিয়েছে তারা। চীনের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে মিল দুটো পরিদর্শন করে গেছে বলেও জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে শ্রমিক নেতা সহিদুল্লাহ চৌধুর জানান, উন্নত দেশগুলোতে ২০২২ সাল থেকে পাট ও তুলাজাতীয় পণ্যের ব্যবহার কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তখন পাটজাত পণ্যের বিপুল চাহিদার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তবে আমলাদের পরামর্শে আকস্মিকভাবে পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত কোনও ভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না।
এ বিষয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মাদ আবুল কালাম জানান, এ মাসের মধ্যেই লিজ প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে আশা করছি। তিনি জানান, মার্চের শেষ সপ্তাহে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হতে পারে। যারা অংশ নেবে তাদের মধ্য থেকে যোগ্যদের নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হবে। এরপর প্রস্তাব চাওয়া হবে।
সান নিউজ/এসএ