নিজস্ব প্রতিনিধি, চাঁদপুর : “চাঁদপুর জেলা ভরপুর জলে আর স্থলে, মাটির মানুষ আর সোনার ফসলে”। স্বল্প শব্দ ব্যয়ে বরেণ্য চারণ কবি ইদ্রিস মজুমদার চাঁদপুর জেলার স্বরূপ তুলে ধরেছেন এইভাবে।
পদ্মা-মেঘনা-যমুনার মোহনা আর ডাকাতিয়া-নদীর আশীর্বাদপুষ্প বাংলাদেশের অন্যতন আলোকিত ইলিশের বাড়ি খ্যাত চাঁদপুর। নদীবন্দর আর নদীবিধৌত এ চাঁদপুর জেলার ঐতিহাসিক জন্মদিন আজ।
১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর মহকুমা হতে নতুন নাম ধারণ করে চাঁদপুর জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সে হিসেবে চাঁদপুর জেলার আজ ৩৭ তম জন্মদিন। এর আগে ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ আমলে প্রশাসনিক পূর্ণবিন্যাসের ফলে চাঁদপুর মহকুমার উৎপত্তি হয়।
১৮৯৬ সালের ১ অক্টোবর চাঁদপুর শহরকে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সে হিসেবে প্রতিষ্ঠার দিক থেকে দেশের সবচেয়ে পুরোনো পৌরসভা চাঁদপুর পৌরসভা। বর্তমানে এই পৌরসভা ১২৫ বছরে পদার্পণ করেছে। ২০১৭ সালে
ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর নামে দেশের প্রথম ব্র্যান্ডিং জেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় সরকার। এর আগে আধুনিক রুপে চাঁদপুরকে দেশ-বিদেশে বিশেষভাবে উপস্থাপনের জন্য ২০১৫ সালের আগস্ট মাস হতে জেলা ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম শুরু করেন তৎকালিন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুস সবুর মণ্ডল। এই নামানুসারে জেলার কৃতিসন্তান বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খান একটি লোগো অঙ্কন করেছেন।
১৯৬০ খ্রি. পর্যন্ত এ জেলার নাম ছিল ত্রিপুরা জেলা। এই ত্রিপুরা জেলা ৪টি মহকুমা নিয়ে গঠিত ছিল। সেগুলো হলো ত্রিপুরা সদর উত্তর, ত্রিপুরা সদর দক্ষিণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর। ত্রিপুরার ২১টি থানা ও ৩৬২টি ইউনিয়ন কাউন্সিল ছিল।
চাঁদপুর মহকুমায় চাঁদপুর, ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, কচুয়া ও মতলব নামে ৫টি থানা ছিলো। বর্তমানে চাঁদপুর জেলার উপজেলা ৮টি এবং পৌরসভা ৫টি। ৮টি উপজেলা হলো, চাঁদপুর, হাইমচর, ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি, কচুয়া, মতলব দক্ষিণ ও মতলব উত্তর।
বর্তমান চাঁদপুর প্রাচীন বঙ্গ সমতট রাজ্যের অধিনে ছিলো। সপ্তম শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদের শেষ দিকে চৈনিক পরিব্রাজক ওয়ান চোয়াঙ সমতট রাজ্যে আগমন করেছেন মর্মে ভ্রমণ বৃত্তান্তে পাওয়া যায়। তিনি সমতট রাজ্যকে সমুদ্র তীরবর্তী নিম্ন আদ্র-ভূমি রূপে বর্ণনা করেছেন যা এ অঞ্চলকে বুঝায়।
প্রাচীন বাংলার গুপ্ত পাল ও সেন রাজবংশের রাজারা এই অঞ্চল শাসন করেছেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। তবে চাঁদপুর জেলার কোনও স্বতন্ত্র আদি নাম সনাক্ত করা সম্ভব না হলেও এ জেলাকে চাঁদপুর হিসেবে নামকরণের ঐতিহাসিক কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
বার ভূঁইয়াদের আমলে চাঁদপুর অঞ্চল বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদরায়ের দখলে ছিল। এ অঞ্চলে তিনি একটি শাসনকেন্দ্র স্থাপন করেন। ঐতিহাসিক জে এম সেনগুপ্তের মতে, চাঁদরায়ের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম হয়েছে চাঁদপুর।
অন্যমতে, চাঁদপুর শহরের (কোড়ালিয়া) পুরিন্দপুর মহল্লার চাঁদ ফকিরের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম চাঁদপুর। কারো মতে, শাহ আহমেদ চাঁদ নামে একজন প্রশাসক দিল্লী থেকে পঞ্চদশ শতকে এখানে এসে একটি নদী বন্দর স্থাপন করেছিলেন। তার নামানুসারে নাম হয়েছে চাঁদপুর।
ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর পুরো বাংলা মুসলিম শাসনের অধিকারে আসার সাথে সাথে এ অঞ্চলও স্বাভাবিকভাবে মুসলিম শাসনের অধিনস্থ হয়। বিশেষ করে সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ এ অঞ্চলে শাসন করেছেন এমন প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুর ২নং সেক্টরের অধিনে ছিলো। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত চাঁদপুর পাক হানাদার মুক্ত হতে থাকে। ৭ এপ্রিল সকাল ৯ টায় পাক হানাদার বাহিনী প্রথম চাঁদপুরের পুরাণবাজারে বিমান হামলা চালায়। তাদের প্রথম দিনের বর্বরতায় এক নারী পথচারি নিহত হয়। এরপর ৮ এপ্রিল ৯৮টি যানের একটি বহর নিয়ে চাঁদপুর শহরে প্রবেশ করে হানাদার বাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন চাঁদপুরের বেশ কয়েকটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এদের মধ্যে বাবুরহাট, টেকনিক্যাল হাইস্কুল, বাখরপুর মজুমদার বাড়ি, ফরিদগঞ্জ-এর গাজীপুর ওটতলী নামক স্থান অন্যতম। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১০টায় চাঁদপুর পুরোপুরি শত্রু মুক্ত হয়। সে হিসেবে এ দিনটি চাঁদপুর মুক্ত দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই চাঁদপুর ব্যবসা-বাণিজ্য সমৃদ্ধ ছিলো এবং সারা ভারতবর্ষে এই জেলার পরিচিতি ছিলো। একটা সময় চাঁদপুরকে বলা হতো গেটওয়ে টু ইস্টান ইন্ডিয়া বা ইন্ডিয়া প্রবেশের গেইট। একটা সময় চাঁদপুর পাটের ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র ছিলো। বর্তমানে চাঁদপুর জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষি ও মৎস্যচাষ নির্ভর।
সম্প্রতিক সময়ে চাঁদপুর বাবুর হাট বিসিক শিল্প নগরীতে বেশ কিছু শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। কৃষি বিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, চাঁদপুর জেলায় দুটি সেচ প্রকল্পের ব্যাপক ভূমিকায় নিজস্ব উৎপাদিত শস্য থেকে এ জেলা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের ১৫ ভাগ খাদ্য উৎপাদন চাঁদপুর জেলার মানচিত্র থেকেই হয়ে থাকে।
রাজধানী ঢাকা থেকে চাঁদপুরের দূরত্ব প্রায় ৯৬ কিলোমিটার। আর বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম থেকে দূরত্ব ২০৮ কিলোমিটার। বর্তমানে কেবলমাত্র বিমান বন্দর ছাড়া চাঁদপুর জেলায় সড়ক, নৌ ও রেলপথের উন্নত যোগাযোগ ব্যাবস্থা রয়েছে। এ জেলার প্রধান সড়ক হল ঢাকা-চাঁদপুর মহাসড়ক এবং চট্টগ্রাম-চাঁদপুর মহাসড়ক।
শুধুমাত্র চাঁদপুর জেলার জন্য আলাদা একটি রেল পথ রয়েছে, যার মাধ্যমে প্রতিদিন চাঁদপুর-চট্টগ্রাম এবং চাঁদপুর-কুমিল্লার আন্তনগর ট্রেন চলাচল করে। এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন জেলা শহর থেকে নৌপথে যোগাযোগের জন্যে রয়েছে চাঁদপুর নদী বন্দর।
সান নিউজ/আশিক/এসএ