নিজস্ব প্রতিনিধি, রাজশাহী : ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছিরা ছুটে চলেন গাছে গাছে খেজুরের সুস্বাদু রস সংগ্রহে। রস নিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পর নারী-পুরুষ মিলেমিশে বড় তাওয়ায় রস জ্বাল দিয়ে তৈরি করছেন পাটালি। রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট ও পুঠিয়ার ঘরে ঘরে চলছে এমন কর্মযজ্ঞ।
রাজশাহী কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, রাজশাহীতে এবার শত কোটি টাকার খেজুর গুড় উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও কৃষি বিভাগ ৭৮ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছে। গুড়ের দাম ৬০ টাকা কেজি হিসেব ধরে এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছ। কিন্তু বর্তমানে বাজারে ৮৫ থেকে ১০০ টাকা মূল্যে গুড় বিক্রি হচ্ছে। সেই হিসেবে লক্ষ্যমাত্রা শত কোটি টাকা পৌঁছে যাওয়ার আশা করছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা।
রাজশাহীর আমের যেমন দেশজুড়ে খ্যাতি রয়েছে, তেমনই খ্যাতি রয়েছে এখানকার খেজুর গুড়ের। জেলার পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার শীতের মৌসুমে গাছ থেকে রস সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি হচ্ছে খেজুর গুড়। এর কেনাবেচায় এখন জমজমাট হয়ে উঠেছে হাটগুলো। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, রাজশাহী জুড়ে খেজুর গাছের সংখ্যা রয়েছে ৭ লাখ ৮০ হাজার। এসব গাছ থেকে প্রতি শীত মৌসুমে প্রায় ৮ হাজার টন গুড় উৎপাদন হয়।
এর মধ্যে চারঘাট উপজেলায় রয়েছে ৩ লাখ ৯৬ হাজার। বাঘা উপজেলায় খেজুর গাছ রয়েছে ২ লাখ ৯৯ হাজার। আর পুঠিয়া উপজেলায় খেজুর গাছের সংখ্যা ৮৫ হাজার। বাঘা উপজেলায় দুটি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নে ৩০ হাজার ৩৮৯ কৃষক পরিবার আছে। খেজুর বাগান আছে ৪ হাজার। এ ছাড়া সড়কপথ, পতিত জমি ও বাড়ির আঙিনা মিলিয়ে দেড় লক্ষাধিক খেজুর গাছ আছে এখানে।
শীতে এসব গাছ হয়ে ওঠে তাদের কর্মসংস্থানের একমাত্র উৎস। একজন গাছি প্রতিদিন ৫০ থেকে ৫৫টি খেজুর গাছের রস আহরণ করতে পারেন। বর্তমানে রস সংগ্রহে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৪ হাজার গাছির ব্যস্ত সময় কাটছে। পুঠিয়ার জাইগিরপাড়া গ্রামের গাছি ফারুক হোসেন বলেন, এবার ভালো শীত পড়ছে। তাই ভালো রসও নামছে। গুড়ের উৎপাদন বেশি হচ্ছে। বাজারে ভালো দামও পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে আবার অনলাইনের গুড় বিক্রি করছেন।
কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে গুড় চলে যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। টাকা আসছে মোবাইলে। গাছিরা জানান, অনেকের নিজের একটি গাছও নেই। তারা প্রতি মৌসুমে ১৭৫ টাকার বিনিময়ে অন্য ব্যক্তির গাছ থেকে রস নামানোর অনুমতি নেন। ১২০টি গাছের রস হলেই বাড়িতে ২৫ কেজি গুড় তৈরি হয়। গুড় তৈরির জন্য জ্বালানি ও সামান্য কিছু কেমিক্যালের খরচ বাদ দিলে ভালো লাভই হয়। গুড় তৈরিতে এ অঞ্চলের পুরুষদের সঙ্গে কাজ করেন নারীরা।
গুড় তৈরির পর পুঠিয়ার বানেশ্বর, ঝলমলিয়া আর বাঘা সদরে নিয়ে পাইকারি দামে বিক্রি করেন গাছিরা। এসব গুড় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, বরিশাল, নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। বাঘা উপজেলায় খেজুর গুড়ের প্রধান হাট বাঘা ও আড়ানি। এরপর আছে মনিগ্রাম ও দীঘাসহ অন্যান্য হাট। সপ্তাহে রোববার ও বৃহস্পতিবার বাঘার হাট বসে।
এখানেই সবচেয়ে বেশি গুড় বেচাকেনা হয়। কারণ বেশি দাম পাওয়ার আশায় অনেকেই বাঘার হাটে গুড় বিক্রি করতে আসেন। বাঘার হাটে রোববার প্রতি কেজি খেজুর গুড় ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি হয়। মৌসুমের একেবারে শুরুর দিকে প্রতি কেজি খেজুর গুড় ৯০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। চারঘাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার বলেন, এবার করোনার কারণে খেজুর গুড়ের বিষয়টি নিয়ে আমাদের উদ্বেগ ছিল।
কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন। গুড় উৎপাদন কিংবা বাজারজাত প্রক্রিয়ায় করোনার তেমন প্রভাব পড়েনি। চাষিরা অন্যবারের চেয়ে দামও ভালো পাচ্ছেন। আমিই গুড় কিনলাম ৮৫ টাকা দামে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক শামসুল হক বলেন, রাজশাহী অঞ্চলের খেজুর গুড় খুবই সুস্বাদু। তাই চাহিদা বেশি। এবার বেশ ঠান্ডা পড়ছে।
এ কারণে গাছে রসের পরিমাণ বাড়ছে। রসের মানও ভালো থাকছে। এ কারণে গুড়ের মানও ভালো হচ্ছে। চাষিরা লাভবান হবেন। আমরা আশা করেছিলাম অন্তত ৭৮ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তা শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। করোনার মধ্যেও শুধু খেজুর গুড়ের কারণে পুঠিয়া, চারঘাট ও বাঘা উপজেলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাঙাভাব বিরাজ করছে।
সান নিউজ/এসএ