মঞ্জুরুল আলম পান্না:
বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন যে স্বাধীনতা, সেই মুক্তি সংগ্রামের বিস্ফোরণের শুরুটা ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমার প্রতিটি সংগ্রাম, প্রতিটি আন্দোলন, অশুভ আর অসত্যের বিরুদ্ধে যে তীব্র প্রতিবাদ, তার সবখানেতে সাহস জোগায় আমার একুশ। শিরায় শিরায় আগুন জ্বালানো মহান একুশের সেই প্রতীক আমাদের ভালোবাসার শহীদ মিনার। অথচ বিশেষ কয়েকটি দিন ছাড়া বছরজুড়ে সারাদেশের শহীদ মিনারগুলো যে কতটা অযত্ন আর অবহেলায় অরক্ষিত থাকে, কেমন করে গরু-ছাগল আর নেশাখোরদের দখলে থাকে, সেসব নিয়ে পত্রিকা আর টেলিভিশনে অনেক সংবাদ হয়েছে।
তবে আজ একটা অন্যরকম শহীদ মিনারের কথা বলতে চাই। বলতে চাই শহীদ মিনারের প্রতি অশেষ ভালোবাসা আর পরম শ্রদ্ধায় নত অন্য এক মানুষের কথা। মানুষের ভালবাসার অনেক ধরণের নিদর্শনের কথা জানা আছে আমাদের। মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসা, নিজ সৃষ্টিকর্মের প্রতি ভালবাসা, গান কিংবা বইয়ের প্রতি ভালবাসা, ফুলের জন্য ভালোবাসা। কিন্তু কারও চিন্তা-চেতনা আর ভালোবাসার পুরোটা জুড়ে যে একটা শহীদ মিনার স্থান করে আছে সে কথা আর ক’জনই বা জানেন!
একজন স্বপন মির্জা, একজন চারণ সাংবাদিক। যার চেতনার সবটুকুজুড়ে রয়েছে একটি শহীদ মিনার। সব ধরনের কাজের মাঝে আর অবসরে এই শহীদ মিনারই যেন তাঁর ধ্যান জ্ঞান। ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিনের নিজ এলাকা সিরাজগঞ্জের চৌহালি-এনায়েতপুরে কিছুদিন আগেও কোনো শহীদ মিনার ছিল না। সেখানকার স্কুল-কলেজগুলোতে কলাগাছ আর বাঁশের অস্থায়ী বেদী নির্মাণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। তাই নিয়েই তাদের কতো উচ্ছ্বাস, কত আবেগ, ভালোবাসা! রাষ্ট্রের চরম অবহেলা এবং নিজের ভেতরকার ক্ষোভ আর হতাশা থেকে একদিন স্বপন মির্জা এনায়েতপুরের গোপীনাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে গড়ে তুললেন একটা ভালোবাসার মিনার। নিজের এক খণ্ড ভূমি না থাকলেও শহীদ মিনারের পেছনে ব্যয় করে ফেললেন তার সঞ্চয়ের পুরোটাই-কয়েক লাখ টাকা। পাশে এসে দাঁড়ালেন হাতে গোনা কয়েকজন শুভ্যার্থী।
গত সাত-আট বছর ধরে এই শহীদ মিনারকে ঘিরেই তাঁর দিনলিপি। একটু একটু করে শহীদ মিনারকে সাজানো, কখনোবা পাশে মাটি ভরাটের কাজ, বছরজুড়ে ফুলের বাগান তৈরি, সীমানা প্রাচীর নির্মাণের চেষ্টা, নিজ হাতে ঝাড়ু দেওয়া। কখনোবা সেখানেই দিনে বা রাতের খাবার খেয়ে নেওয়া কিংবা ক্লান্ত অবসন্ন দেহে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়া।
এলাকার বিভিন্ন সামাজিক আর সাংস্কৃতিক আয়োজন চলে শহীদ মিনারকে ঘিরে। এই শহীদ মিনারই যেন স্বপন মির্জার আরাধ্য পবিত্র ভূমি, তার তীর্থ স্থান। স্বাধীন এই ভূখণ্ড নির্মাণে যারা যুগে যুগে রক্ত দিয়ে গেছেন সেই শহীদ সূর্যসন্তানদের প্রতি কী পরিমাণ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা থাকলে একটা মানুষ এভাবে শহীদ মিনারকে ভালোবাসতে পারেন তার কি কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে?
অথচ সেই শহীদ দিবস আমাদের অনেকের কাছে এখন যেন কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদের রক্তমাখা রাজপথ মনে করে বিনম্র শ্রদ্ধায় খালি পায়ে ফুল হাতে অন্ধকার মাখা প্রভাত ফেরি। কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ শিহরণ জাগানিয়া সুর। কী এক তুমুল আবেগ জাগানিয়া ভালোবাসা, শ্রদ্ধা...!!
এই তুমুল ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিংড়ানো সংস্কৃতিকে আমরা পায়ে পিষতে শুরু করেছি বিশ্বায়নের সস্তা চেতনায়। জুতা পায়ে প্রভাত ফেরি!! এক সময় কল্পনার বাইরে ছিল। এখন একুশের প্রথম প্রহরে কিংবা প্রভাত ফেরিতে জনে জনে চলেন জুতা পায়ে। কোথায় ভালোবাসা, কোথায় শ্রদ্ধা, কোথায় আবেগ! চেতনাজুড়ে ঘুণপোকার বসতি! জীবনের একটা মূল্যবান সময় কেটেছে আমার রাজপথে একজন সক্রিয় সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে। এক যুগ আগে আমি খুলনায় যখন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একটা দায়িত্বশীল পদে তখন সাংস্কৃতিক যোদ্ধাদেরও কেউ কেউ জুতা পায়ে অবলীলায় চলে আসতেন একুশের প্রথম প্রহরে কিংবা প্রভাত ফেরিতে। প্রতিবাদ করলে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলতেন-‘জুতা পায়ে এলে কী হয়েছে?’
কী বলব? তাই তো, প্রভাত ফেরিতে না এলেও বা কী হয়েছে?!! শহীদ মিনারে ফুল না দিলেও বা কী হয়েছে?!! কী দরকার লোক দেখানো এসব সৌজন্যতার?!! জুতা পায়ে প্রভাত ফেরিতে কাউকে দেখলেই মনে হয় যেন শহীদের পবিত্র রক্তকে অপমান করছি, ঠিক যেমনটা জুতা পায়ে শহীদ বেদিতে ওঠার বিষয়টি। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে কে কার আগে বেদিতে ফুল দিতে পারবে এমন নোংরা প্রতিযোগিতায়ও আমরা দেখেছি-জুতা পায়ে অবলীলায় নেতা-কর্মীদের শহীদ বেদিতে উঠে যাওয়ার চরম জঘন্য দৃশ্য।
একুশ এখন পুঁজিওয়ালাদের ব্যবসার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একুশের গুরুত্ব, ভাবগাম্ভীর্য ভুলে গিয়ে পুরো বিষয়টাকে উৎসব বানিয়ে ফেলছি আমরা। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো একুশের চেতনাকে পুঁজি করে বড় বড় বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করে লুটে নেয় গরিবের টাকা। নামিদামি থেকে শুরু করে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলোতে ‘একুশের সাজ’ শিরোনামে প্রকাশ হয় বিশেষ বিশেষ আয়োজন।
সেখানে একুশের গয়না, একুশের শাড়ি, একুশের পাঞ্জাবি আরও কত কি বাহারি আয়োজনের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা! কোনো কোনো পত্রিকায় একুশ উপলক্ষে বিশেষ খাবার-দাবারের বর্ণনাও তুলে ধরা হয় নির্লজ্জভাবে।
ছাপা হয় ‘একুশের কেক’-এর ছবি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ বেদিতেই বর্ণিল সাজে জমে ওঠে হাত থেকে হাতে সেলফি তোলার প্রতিযোগিতা। পুঁজিবাদের ঢেউয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমার আবেগ, পুঁজিবাদের আছড়ে পড়া স্রোতে ক্ষত-বিক্ষত আমার চেতনা, পুঁজির জোয়ারে পথ ভুলে যায় আমার অস্তিত্ব।
ভাষা আন্দোলনে চূড়ান্ত সূচনা পর্বে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নির্মিত শহীদ মিনারকে ভয় পেয়ে তা প্রথম রাতেই গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি শাসকরা। সেই শহীদ মিনারকে আজ আমরাই অপমান করে চলেছি প্রতিনিয়ত। তবে শহীদের রক্তে ভেজা চেতনার মানুষের সংখ্যাও নিশ্চয় এখনো কম নয়। বাংলার আনাচে কানাচে নিশ্চয় অনেক স্বপন মির্জা এখনো জেগে আছেন শহীদ মিনার আর শহীদ দিবসের প্রহরী হয়ে।