এম.এ আজিজ রাসেল: টানা ভারী বর্ষণ ও সাগরের পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার ৮ উপজেলার ৬৩টি ইউনিয়নের অন্তত প্রায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে এখনও। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ তে। পাহাড়ি ঢলের কারণে জেলার প্রধান নদী মাতামুহুরী, বাঁকখালী ও ঈদগাঁও নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদীগুলোর তীরবর্তী এলাকার ৬৮ হাজার ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বন্যার পানিতে কক্সবাজার—চট্টগ্রাম মহাসড়কের কয়েকটি স্থান তলিয়ে গিয়ে নদীর চেহারা নিয়েছে। এতে যানবাহন চলাচল চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এর আগে সোমবার বন্যার পানিতে ভেসে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। বর্তমানে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আরও পড়ুন: পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণ করবে সরকার
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণকক্ষের হিসাবে, জেলার ৮ উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের ৪ লাখ ৭১ হাজার ৫০৩ জন মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পানিতে তলিয়ে গেছে চিংড়ি ঘের, বীজতলা, উৎপাদিত ফসল, লবণ ও পানের বরজ। জেলা প্রশাসনের তথ্যে এ পর্যন্ত ১ কোটি ৪০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে এই চিত্র দশগুণ বেশি। এ পর্যন্ত ২০৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৩৫ হাজার ৭৫২ জন আশ্রয় নিয়েছে। এ ছাড়া জেলার ৫৯ কিলোমিটার সড়ক বন্যায় ডুবে গেছে। বন্যা কবলিত এলাকায় এ পর্যন্ত ৮৩ মে. টন চাল ও নগদ ৯ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ। এছাড়া জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ইতোমধ্যে ৩৭ হাজার ৫০০ বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ২০০টি পানির জেরিকেন এবং ৫ হাজার লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করেছে। আরও ৫০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট মজুদ রয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ আরও বলেন, বন্যা কবলিত মানুষের জন্য আরও ৭৬৭ মে. টন চাল, ২০ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ও ৬ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার মজুদ রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী তানভীর সাইফ আহমেদ বলেন, পূর্ণিমার জোয়ারে চকরিয়ার কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে (৮০ সেন্টিমিটার) প্রবাহিত হচ্ছে।
এর ফলে নদীর দুই তীরের ১০—১৫টি গ্রামের শত শত ঘরবাড়ি নিমজ্জিত হয়েছে। রামুর বাঁকখালী নদীর পানিও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ওই এলাকার কয়েকটি গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন: দেশে পৌঁছেছেন সুফিউল আনাম
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, সবচেয়ে বেশি বন্যাকবলিত হয়েছেন চকরিয়া উপজেলার ১৮ ইউনিয়নের অন্তত দেড় লাখ মানুষ। পাশের উপজেলা পেকুয়াতে ৭ ইউনিয়নের অন্তত ৮৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন।
চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, মাতামুহুরী নদীর পানি উপচে এবং বেড়িবাঁধ ভেঙে কাকারা, লক্ষ্যারচর, বুমুবিল ছড়ি, সুরাজপুর—মানিকপুর, কৈয়ারবিল, কোনাখালীসহ চকরিয়ার ১৮ ইউনিয়নের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন।
রান্নার কাজ বন্ধ থাকায় শত শত ঘরে খাবারের সংকট চলছে। অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিতে ডুবে থাকায় পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, বন্যার পানিতে চকরিয়া ও পেকুয়া এবং কক্সবাজার সদরের পোকখালী ও গোয়াখালীতে ৬০—৭০টি স্কুলে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।
আরও পড়ুন: বিদেশিরা বাংলাদেশের মঙ্গল চায় না
চকরিয়ার কোনাখালীর কৃষক আবদুল মান্নানের (৫৫) বসতভিটা তিন দিন ধরে ডুবে আছে বলে তিনি জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে তাঁর মাটির ঘরের একটি দেয়াল ধসে পড়েছে। পুরো এলাকা পানিতে ভাসছে। ওই এলাকায় বহু মাটির ঘর ধসে পড়েছে বলে জানান আবদুল মান্নান।
এদিকে ঈদগাঁও উপজেলার ঈদগাঁও, জালালাবাদ ও পোকখালী ইউনিয়নের ৬০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন জালালাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান ইমরুল হাসান।
তিনি বলেন, পাহাড়ি ঢলের কারণে ঈদগাঁও নদীর পানিও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে এ তিন ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ৫ হাজার নারী উদ্যোক্তা পাবেন অনুদান
জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ভারী বর্ষণ ও পূর্ণিমার উচ্চ জোয়ারের প্রভাবে চকরিয়া, পেকুয়া, ঈদগাঁও, কক্সবাজার সদর, রামু, টেকনাফ, উখিয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। দুর্গত ব্যক্তিদের মধ্যে দ্রুত শুকনা খাবার পৌঁছানো হচ্ছে। গৃহহীন মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্রে সরানো হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, জেলার প্রতিটি উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) নৌকা নিয়ে পানিবন্দী মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছেন এবং তাঁদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসছেন।
সান নিউজ/এইচএন