জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা। গলছে হিমবাহ, বাড়ছে সমুদ্র পুষ্ঠের উচ্চতা। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্বরের উপকূলীয় অঞ্চল। বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ বসচে হুমকির মুখে তার একটি বাংলাদেশ।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা যে হারে বাড়ছে তা অব্যাহত থাকেলে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের এক বিস্তীর্ণ সমুদ্রের লোনা পানির নিচে তলিয়ে যাবে। উদ্বাস্ত হবে প্রায় তিন কোটি মানুষ । বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন কিছু কিছু অঞ্চলের আবহাওয়ার সঙ্কটময় অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে তুলবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী, মোটামুটি ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে আরও বেশি হুমকির মুখে ফেলবে।
দেশের লাখ লাখ নাগরিককে নানা সময়ে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, দাবদাহ ও খরার মতো মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বেশিরভাগটাই শুরু হয়েছে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে। শিল্পায়নের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। সেই থেকে বেড়েই চলেছে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন।
আমরা যে বদ্বীপে আছি এবং সমুদ্রের সঙ্গে যে সম্পর্ক, তাতে আমরা খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছি। এর বিরূপ প্রভাব এমন চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে যাচ্ছে, যা জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে।
আইপিসিসির হিসেবে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা যদি এক মিটার বাড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ১৭ থেকে ২০ শতাংশ জমি সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। উদ্বাস্ত হবে প্রায় ২ কোটি মানুষ। এত মানুষকে দেশের অন্যত্র স্থানান্তরের সুযোগ নেই। দেশের বিভাগীয় শহরগুলো মানুষের এতটা চাপ সহ্য করতে পারবে না। তাই সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার হুমকি দেখা দেবে।
বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত আট লাখ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ২০১৬-১৭ সালে নির্গত হওয়া কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ সর্বোচ্চ। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়েছে। আবহাওয়া ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, কার্বন নিঃসরণের বিদ্যমান ধারা অব্যাহত থাকলে বর্তমান শতাব্দীর মধ্যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পবিপ্লব সময়ের তুলনায় ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। এতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
আবহাওয়ার তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বৈরী পরিবেশের প্রভাবে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, অসময়ে প্রবল বৃষ্টিপাত ও ফসলের মৌসুমে বৃষ্টিহীন, মাটির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াসহ অর্থনীতি ও মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার মতো দুর্যোগ বেড়ে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের চাপ আসছে। ২০ শতাংশ জমি কমবে, জনসংখ্যা বাড়বে। আর লবণাক্ততা যেটা বাড়বে, তার ফলে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে। ইতিমধ্যে মিঠা পানির জলাধারেও লবণাক্ততা এসে যাচ্ছে। তাই খাদ্য উৎপাদনে যে সক্ষমতা এখন আছে, সেখানে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। ২০৫০ সালের মধ্যে যে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আছে, সেটা ৮ শতাংশ কমে যাবে। গম উৎপাদন কমবে ৩২ শতাংশ। বাড়বে মানুষ কমবে কৃষিজমি।
জলবায়ু পরিবর্তনের নষ্ট হবে খাদ্যনিরাপত্তা। একই সাথে বাংলাদেশে সুপেয় পানির বিরাট ঘাটতি দেখা দেবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই পানির চক্রগুলো বদলে যাচ্ছে। যখন পানি আসার কথা, তখন পানি আসছে না। একই সঙ্গে নিম্ন অববাহিকার দেশ হওয়ার কারণে উজান থেকে যে প্রবাহ আসার কথা, সেটাও আসছে না। সেখানে নানা বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও হবে। শুধু মানুষের জীবন জীবিকার জন্য নয়, পুরো ইকোসিস্টেমকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন পানির অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিবেশে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটতে পারে। সুন্দরবনে লবণাক্ত পানি ভেতরে চলে আসছে, এ কারণে অনেক গাছপালা মরে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর, আইলা, মহসিন, বুলবুল প্রতিহত করার মতো কোন প্রাকৃতিক ঢাল থাকবে না। মানুষের জীবন, জীবিকা ও স্বাস্থ্যের ওপর চাপ বাড়তে থাকবে। পানিবাহিত রোগ বাড়বে।
যুক্তরাজ্যের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ কামিল পারমেসান বলেন, হাজারো প্রজাতির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত শতকে অনেক প্রজাতি এলাকা পরিবর্তন করে মেরু অঞ্চল বা উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে চলে গেছে। সব গবেষণার মধ্যে অর্ধেকের বেশি গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রজাতির স্থানান্তর ঘটেছে এবং অধিকাংশ বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।