আন্তর্জাতিক ডেস্ক: হাতি স্বভাবগতভাবে বুদ্ধিমান প্রাণী। যেসব হাতি বিশেষজ্ঞরা তাদের আচরণ নিয়ে গবেষণা করেন, চীনে একপাল বিপন্ন প্রজাতির বন্য হাতির আচরণ সেসব বিশেষজ্ঞদের সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি করে দিয়েছে।
চীন জুড়ে দেশটির সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কর্তৃপক্ষও এই হাতির পাল ও তাদের দীর্ঘ যাত্রা নিয়ে রীতিমতো উৎসুক। খবরের কেন্দ্র জুড়ে রয়েছে এখন এই হাতির পাল।
হাতিরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। সেটা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু সেটা সচরাচর হয় খুবই কম দূরত্বের পথ।
কিন্তু এই হাতির পাল এক বছরেরও ওপর হয়ে গেল। চীনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের যে জঙ্গলে মূল আস্তানা ছিল, সেখান থেকে তারা এখন দীর্ঘ প্রায় পাঁচশ কিলোমিটার (৩১০ মাইল) পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, গত বছর বসন্তকালে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমে শিশুয়াংবান্না ন্যাশনাল নেচার রিজার্ভ নামে দেশটির সংরক্ষিত অরণ্য এলাকা থেকে এই হাতির দলটি তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। ওই অরণ্য এলাকা চীনের সঙ্গে মিয়ানমার ও লাওস সীমান্ত এলাকার কাছে।
সেখান থেকে তারা চীনের উত্তর দিকে চলতে শুরু করে এবং গত কয়েক মাসে দেখা গেছে দেশটির বেশ কিছু গ্রাম, নগর ও শহরের মধ্যে দিয়ে তারা হেঁটে চলেছে।
গজেন্দ্র গমনে, ধীর পায়ে মানুষের বাসায় পর্যন্ত গিয়ে ঢুকেছে। একটি ঘটনায় দেখা গেছে, এক বাড়ির উঠানে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে এই হাতির দল শুঁড় দিয়ে সফলভাবে কল খুলে পানি খেয়েছে।
এই হাতিগুলো দল বেঁধে কেনই বা তাদের আস্তানা ছেড়ে এত দূরের পথ পাড়ি দিতে বেরিয়েছিল, কেন তারা দেশের উত্তর-মুখে রওয়ানা হল, এখন আবার কেন তারা দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করল- এসব কিছুর কোন উত্তরই খুঁজে পাচ্ছেন না হাতি-বিজ্ঞানী বা হাতি-বিশারদরা। এরপর কী ঘটতে চলেছে তাও তাদের জানা নেই।
নিউ ইয়র্কে সিটি ইউনিভার্সিটির অধীন হান্টার কলেজের হাতির মনস্তত্ত্ব বিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক জশুয়া প্লটনিক বলেছেন, "এটা ধারণা করা মোটেই অসঙ্গত হবে না, কারণ এশিয়ান হাতি যেসব এলাকার বনাঞ্চলে বাস করে, সেখানে অরণ্যের ভেতর মানুষের কর্মকাণ্ড আগের তুলনায় বেড়ে যাওয়ায় বনের ভেতর তাদের শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে, তারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে।
তাদের আবাস স্থল সঙ্কুচিত হচ্ছে, তারা বড় দলে এক হয়ে থাকতে পারছে না- থাকছে ছোট ছোট দল বেঁধে। বনজঙ্গল কেটে ফেলায় তাদের খাদ্যসম্পদেও টান পড়ছে,"।
চীনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই হাতির পালটি যখন যাত্রা শুরু করে তখন তাদের দলে ছিল ১৬ বা ১৭টি হাতি, যাদের মধ্যে তিনটি ছিল মদ্দা হাতি।
এদের মধ্যে দুটি পুরুষ হাতি এক মাস পরই দল ছেড়ে চলে যায়। আর এমাসের গোড়ায় তৃতীয় মদ্দা হাতিটিও দল ত্যাগ করে চলে গেছে।
জাম্বিয়া ভিত্তিক একটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা গেম রেঞ্জারস ইন্টারন্যাশানালের লিসা অলিভিয়ের বলেছেন, হাতির দলটির একসাথে ঘুমানোর ভাইরাল হওয়া বিখ্যাত ছবিটিতেও হাতির অস্বাভাবিক আচরণের পরিচয় রয়েছে।
জায়গা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে:
বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে একমত যে, এটা হাতিদের স্থান পরিবর্তন নয়, কারণ তারা কোন নির্দিষ্ট পথ ধরে এই যাত্রা করেনি।
তবে পৃথিবী যে মাত্র গুটিকয় হাতে গোনা জায়গায় হাতির বংশবৃদ্ধি হচ্ছে তার একটি হল চীন। এর কারণ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে চীনের বিশাল উদ্যোগ।
ব্যবসার কাজে চুরি করে হাতি শিকার চীন কঠোর হাতে দমন করেছে। এর ফলে চীনের ইউনান প্রদেশে বন্য হাতির সংখ্যা, যা ১৯৯০এর দশকে ছিল ১৯৩ তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০০এ।
তবে নগরায়ন আর বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে হাতির আবাসস্থল হুমকির মুখে পড়েছে এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফলে তারা হয়ত নতুন আস্তানা খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং খুঁজে বেড়াচ্ছে আরও ভাল খাবারের উৎস ও ভাণ্ডার।
জঙ্গলের এই বিশাল আকৃতির প্রাণীটির ক্ষুধা মেটানো চাট্টিখানি কথা নয়। প্রতিদিন তাদের পেট ভরানোর জন্য হাতিকে ১৫০ থেকে ২০০ কিলোগ্রাম পরিমাণ আহার সংগ্রহ করতে হয়।
আকাশ থেকে নজরদারি:
তবে বিশেষজ্ঞরা একটা বিষয়ে খুশি যে এই বন্য হাতির দলটির সাথে মানুষের মুখোমুখি কোন বিপজ্জনক সংঘাত হয়নি। এছাড়াও তাদের এই অভিনব যাত্রায় ইতিবাচক কিছু ফলও হয়েছে।
চীনা কর্তৃপক্ষ তাদের যাত্রা ও গতিপথের ওপর নজর রাখতে যে ড্রোন ব্যবহার করছে, তার ফলে হাতি গবেষকরা হাতিদের বিরক্তির উদ্রেক না করে তাদের সম্পর্কে গবেষণার জন্য বহু মূল্যবান তথ্য পেয়েছেন।
সাম্প্রতিক কয়েক মাসে চীনের কর্মকর্তারা হাতিগুলোকে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নিরাপত্তায় ফিরিয়ে নিতে ট্রাক ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের জন্য টোপ হিসাবে খাবার ছড়িয়ে রেখেছে।
চীনের সংবাদমাধ্যমগুলো প্রতিদিন এই হাতির পাল কোথায় আছে - কী করছে তার খবর দিচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমেও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য এই হাতির পাল রীতিমত 'তারকা' ও 'হিট'।
এই হাতির দলটির দিকে নজর রাখছে বিশ্বের মিডিয়াগুলোও- সারা বিশ্বে এই হাতিরা এখন একটা বড় আকর্ষণের বিষয়। এই হাতির দল তাদের সমস্যা ও দুর্দশার কাহিনি যেভাবে বিশ্বের নজরে এনেছে তাদের এই অভিনব পদযাত্রার মধ্যে দিয়ে তা সত্যিই নজিরবিহীন।
"এর মধ্যে দিয়ে সারা বিশ্বে হাতির সংরক্ষণের বিষয়টি অবশ্যই সামনে চলে আসবে সন্দেহ নেই," বলছেন মিজ লিসা অলিভিয়ের।
সান নিউজ/এমএম