নিজস্ব প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম ওয়াসা নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে হালদা নদীতে বাড়বে লবণাক্ততা, হুমকি মুখে পড়বে কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্রসহ ডলফিন ও জীববৈচিত্র্য। শুধু তাই নয়, হালদা নদীর জন্য তা ধ্বংস বয়ে আনতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের সেই সতর্ক বার্তায় কান না দিয়ে প্রকল্পটির পক্ষে অনড় কর্তৃপক্ষ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ,ম রেজাউল করিম, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াছ হোসেন ও চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ।
প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষা মঞ্চের আয়োজনে সম্প্রতি ‘হালদা নদীর পানি উত্তোলন ও তার প্রভাব’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞরা জানান, বিশেষজ্ঞ সমীক্ষার নামে প্রতারণার মাধ্যমে হালদা নদী থেকে পানি উত্তোলনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে হালদাকে মেরে ফেলার আয়োজন চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মোহরা ও মদুনাঘাট পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় প্রতিদিন ১৮ কোটি লিটার পানি উত্তোলন করা হয় হালদা নদী থেকে, যা চট্টগ্রাম নগরীর চাহিদা মিটায়। এর মধ্যে মিরসরাইয়ের বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরীতে পানি সরবরাহ করতে আরও একটি নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে ওয়াসা। এই অংশ দিয়ে প্রতিদিন তোলা হবে আরও ১৪ কোটি লিটার পানি। অর্থাৎ একটি নদী থেকে দিনে মোট ৩২ কোটি লিটার পানি টেনে নিলে ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়াটাই স্বাভাবিক। অথচ অনভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের দিয়ে এ বিষয়ে সমীক্ষার মাধ্যমে প্রতারণা করা হয়েছে। সেসব বিশেষজ্ঞদের পানি উত্তোলনের বিষয়ে দেওয়া তথ্যও ভুলে ভরা, বিজ্ঞানসম্মত নয়।
এমনিতে নানা দূষণ ও পানি উত্তোলনের ফলে নদীর মা মাছ ও ডলফিন হুমকির মুখে পড়েছে। নতুন করে দিনে ১৪ কোটি লিটার পানি তোলা হলে এ নদীর জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হয়ে যাবে। আসছে ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয় কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন পূর্ব মাস। এ সময় মা মাছের পর্যাপ্ত গুণগতমান পানি ও খাবার যেমন- প্লাংটন মাইক্রোবেনথিক অর্গানিজম দরকার।
কিন্তু এ সময় যদি সব মিলিয়ে নদীর মোট ৩০ শতাংশ পানি তুলে নেওয়া হয় তাহলে পানি স্বল্পতা ও লবণাক্ত বেড়ে সেগুলো হুমকির মুখে পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলেন- আমরা উন্নয়ন চাই, তবে নদীকে মেরে ফেলে নয়। হালদা নদী থেকে মদুনাঘাট-মোহরা পানি শোধনাগার, ভূজপুর রাবার ড্যাম, হারুয়াছড়ি রাবার ড্যাম, ধুরং কংক্রিট ড্যাম ও হাটহাজারী অংশে প্যারালাল খালে ১৮টি স্লুইস গেট দিয়ে নিয়মিত পানি তোলা হচ্ছে।
নতুন করে পানি উত্তোলনের পক্ষে খোঁড়া যুক্তি দিয়ে হালদাকে মেরে ফেলার আয়োজন কখনো মেনে নেওয়া যায় না। এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্রকে রক্ষায় বিকল্প উৎস থেকে পানি নেওয়ার কোনও বিকল্প নেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘শিল্পনগরীর জন্য এ নদী থেকে নতুন করে পানি টানা হলে হালদার ইকোসিস্টেম নষ্ট হয়ে যাবে।’ যদিও চট্টগ্রাম ওয়াসার নতুন প্রকল্পের পক্ষেই যুক্তি দাঁড় করিয়ে নদী গবেষক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, ‘হালদার পানি কর্ণফুলী নদী থেকে আসে। তাই ওপর থেকে হালদাকে অত্যাচার না করলে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’
চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ বলেন, ‘৩২ কোটি লিটার পানি উত্তোলনে হালদার জীববৈচিত্র্য, মা মাছ কিংবা ডলফিনের কোনও ক্ষতি হবে না। কর্ণফুলীর সঙ্গে হালদা নদী যেখানে এসে মিশছে তার এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি উত্তোলন করব। জোয়ার-ভাটার নদী, পানি উত্তোলনে প্রভাব পড়বে না।
ওয়াসার এমডির সুরেই কথা বলেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত মোহরা ফেজ-২ প্রকল্পের জন্য সীমিত পরিমাণ যে পানি তোলা হবে, তাতে জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব পড়বে বলে পরিবেশবিদরা দাবি করছেন। যদিও সমীক্ষায় সেটি প্রতীয়মান হয়নি। এ নিয়ে অনেক গবেষণাও করা হয়েছে। মৎস্য প্রজনন এবং জীববৈচিত্র্যের পরিবেশ অক্ষুন্ন রেখেই হালদার পানি তোলা হবে। প্রকৃতি হুমকির মুখে পড়বে, এমন কাজ কখনই করা হবে না।’
হালদা নদী থেকে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ডিম সংগ্রহের কাজ করেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ মো. কামাল উদ্দিন সওদাগর। তিনি অবশ্য বলেন, ‘আমার এত বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, পানি উত্তোলন প্রকল্প হালদার জন্য হুমকি হবে। এক সময় হালদার গভীরতা ছিল তিনশ থেকে সাড়ে চারশ ফুট। বর্তমানে এই গভীরতা এসে দাঁড়িয়েছে ৫০ ফুট। স্থানভেদে আরও কম।
মূলত ১৪-১৫টি স্লুইস গেট, রাবার ড্যাম, ৮-৯টি বাঁক কাটা, হালদার ভাঙনরোধে পাথর ব্লক ফেলার কারণে এবং পাহাড়ি ঢল নেমে আসতে না পারায় গভীরতা কমেছে। এখন পানি উত্তোলন করলে হালদার মৃত্যু নিশ্চিত। পানি উত্তোলনে পানি কমবে তা নয়, লবণাক্ত পানি ঢুকে প্রাকৃতিক প্রজননের ক্ষতি হবে।’ শুধু কামাল সওদাগরই নন, ২০ জনেরও বেশি ডিম সংগ্রহকারী বলেছেন একই কথা।
হালদা থেকে পানি সরবরাহ করতে গিয়ে যদি নদীর ক্ষতি হয় মৎস্য মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। অক্টোবরে হালদা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ‘মানুষের বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহের অধিকার রয়েছে। কাজেই বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা আমাদের দায়িত্ব। যদি দেখা যায়, সে পানি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে হালদার স্বাভাবিক অবস্থা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটাই আমরা নেব।’
সান নিউজ/এসএ