মো. নাজির হোসেন, মুন্সীগঞ্জ: মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার আউটশাহী ইউনিয়নের মামাদুল গ্রামের একই পরিবারে রয়েছে অন্ধ ৫ বাউল শিল্পী। চোখে দেখতে না পেলেও ৩ প্রজন্মের এ বাউল শিল্পীদের গানে মুগ্ধ হয়ে থাকেন স্থানীয় বাউল গানের ভক্তকুল। ইন্টারনেটের এ যুগে এখন আর গ্রাম-গঞ্জে বাউল গানের আসরের আয়োজন আগের মতো নেই। তাই গ্রামের এই বাউলদের কদরও কমেছে। এতে অন্ধ বাউলদের পরিবার এখন আর ভালো নেই। এখন অনেকেই ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে গান শুনে থাকেন।
আরও পড়ুন: শেখ কামালের ৭৪ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন
অথচ আগে যেখানে একই দিনে ৪-৫ টি আসনের বায়না আসতো, সেখানে এখন মাসে দুই একটার বেশি বায়না হয় না। তাই আর্থিক অভাব-অনটনে দিন কাটছে এই বাউল পরিবারের। অন্যদিকে একই বাউল পরিবারের সদস্য অন্ধ হওয়ায় অন্য কোন জীবিকা করেও আয় করতে পারছে না।
বংশ পরম্পরায় ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে অন্ধ বাউল শিল্পী পরিবারের পূর্ব-পুরুষরাও অন্ধ ছিলো এবং তারাও বাউল ছিলো। এই বাউল পরিবারে মধ্যে মারফত আলী বয়াতি ছিলেন এ অঞ্চলের নামকরা বাউল শিল্পী। তিনি অধ্যাত্মিক বাউল শিল্পী ছিলেন। ১২ শতাধিক গান রচয়িতা অন্ধ বাউল শিল্পী প্রায় ২৫ বছর আগে মারা যান। সেও জন্মগত অন্ধ শিল্পী।
জানা যায়, তার বাবা কাদের ফকিরও ছিলেন এ উপজেলার নামকরা বাউল। সেও অন্ধ ছিল। কাদের বাউল প্রায় ৮০ বছর আগে ১২০ বছর বয়সে মারা গেছেন। কাদের বাউল মৃত্যুর আগে ৪ ছেলে রেখে মারা যান। ছেলেরা হলেন, জাফর আলী বাউল, মারফত আলী বাউল, সবুজ আলী ও কুদরত আলী। এর সবাই গান করলেও এদের মধ্যে মারফত আলী বাউল ছিলেন সুনামধণ্য একজন বাউল শিল্পী ও অধ্যাতিক জগতের মহাপুরুষ।
আরও পড়ুন: উলিপুরে শিক্ষক আজম আলীর জানাজা সম্পন্ন
তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৮০) বলেন, তার স্বামী মারফত আলী বাউল ছিলেন একজন সুনামধন্য বাউল শিল্পী। তার গান টিকিট কেটে মানুষ শুনতো। এক সময় তাদের বাড়িতে মানুষের ভীড় লেগেই থাকতো। ১০৫ বছর বয়সে মারা যায় সে।
মৃত্যুকালে এই অন্ধ বাউল ৪ ছেলে সন্তান রেখে মারা যান। তারা হলেন আমির হোসেন বয়াতি (৬৫),আনোয়ার হোসেন বয়াতি (৬৩), মোয়াজ্জেম হোসেন (৫৫) ও নজরুল ইসলাম বয়াতি (৫০)। এদের মধ্যে বাবা মারফত আলি বয়াতির কাছে গান শিখেছে ৩ ছেলে আমির হোসেন বয়াতি, আনোয়ার হোসেন বয়াতি ও নজরুল ইসলাম বয়াতি। মোয়াজ্জেম হোসেন তিনি তেমন গান করেন না। অনোয়ার হোসেন বয়াতি এক সময় গান করলেও এখন অনেকটা ছেড়ে দিয়েছেন এ পেশা।
এদের মধ্যে আমির হোসেন বয়াতি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত বয়াতি শিল্পী তিনিও ভালো গান করতেন। নজরুল ইসলাম বয়াতিও অন্ধ তিনিও গান করেন। আমির হোসেন বয়াতির ৩ ছেলেও অন্ধ তারাও বাউল শিল্পী। তারা হলেন সেন্টু বয়াতি (৪০), মিন্টু বয়াতি (৩৫) ও হৃদয় বয়াতি (৩২) । সেন্টু বাউলেরও রয়েছে এক ছেলে নাম আব্দুর রহমান (৫)। সেও অন্ধ চোখে দেখে না। তবে বাবা সেন্টু ও দাদা আমির হোসেনের কাছে গানের শিক্ষা নিচ্ছে সে। বংশ পরস্পরায় ২০০ বছর ধরে চার অন্ধ এ বাউলরা হাজারো গান মুখস্থ গেয়েই শোনাচ্ছেন মানুষদের। ৪ দিন আগে মারা গেছেন আমির হোসেন বয়াতি।
আরও পড়ুন: নওগায় নির্যাতনে যুবকের মৃত্যু
মৃত্যুর আগে তিনি বলেছিলেন, আমার দাদা কাদের ফকির ছিল অন্ধ বাউল। আমার বাবা মারফত আলী বায়াতিও ছিল অন্ধ বাউল। আমি আমার বাবার কাছ থেকে গান শিখেছি। বাংলাদেশের যত নামকরা বাউলশিল্পী রয়েছে আমি প্রায় শিল্পীর সাথে গান করেছি। আমি বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের সাথেও গান করেছি। শিল্পী খালেক দেওয়ান, রজ্জব আলী দেওয়ান, সালাউদ্দিন, আবুল সরকার, ছোট আবুল সরকার, পরেশ দেওয়ানের সাথে গান গাইছি। আমি বেতার টেলিভিশনে গান করি। আমি যখন ছোট ১০-১২ বছর আমার বাবার সাথে তখন থেকেই গানের সাথে সখ্যতা গড়ে।
নজরুল ইসলাম বয়াতি বলেন, প্রথমত শিল্পী ছিল আমার দাদা কাদের ফকির। সে ভালো অন্ধ শিল্পী ছিল। আমার বাবা মারফত আলি বাউল সে ছিল নামকরা বাউল শিল্পী। আমার বাবার কাছ থেকে আমরা শিক্ষা নিছি তার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে গান গাই। তিনি বলেন, আগে মাসে আমরা ২০ টা ২৫ টা বাউল গানের প্রোগ্রাম করতাম। এখন মাসে দুইটা প্রোগ্রাম করতে পারি না। আমরা যাতে চলতে পারি সরকার এবং সংস্কৃতির কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য সেই দৃষ্টি রাখবেন। আমরা যদি ঠিকমতো চলাফেরা করতে না পারি আমাদের যে প্রাচীন বাউল গান সংস্কৃতি আছে প্রাচীন সুরগুলি ভবিষ্যতে আর থাকবেনা বিলীন হয়ে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: ২ পক্ষের সংঘর্ষ, নারীসহ আহত ৫০
বাউল শিল্পী সেন্টু বলেন, আমার দাদা, দাদার বাবা, চাচারা, আমার বাবা, আমি, আমার দুই ভাই সবাই অন্ধ বাউল শিল্পী। আমার ছেলে আব্দুর রহমানও অন্ধ। আমি আমার ছেলেকেও শিল্পী বানাতে চাই। আমার পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই।
এ ব্যাপারে স্থানীয় আউয়াল ব্যাপারী বলেন, মারফত আলী বাউল মুন্সীগঞ্জের বড় বয়াতি ছিল। এখন ওর পোলারা গান গায়। তবে ওর পোলারা একটু নরম হয়ে গেছে আর্থিক অবস্থায়। এখন বাউল গান মানুষ বেশি শুনেনা। এজন্য ওদের অবস্থা খারাপ। মারফত আলী বয়াতির ছেলেরা ও নাতিরাও গান গায়।
সান নিউজ/এইচএন