সান নিউজ ডেস্ক: কিংবদন্তি হুমায়ূন ফরিদীকে হারানোর ১১ বছর আজ। ২০১২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি হঠাৎ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন অভিনয়ের এই ‘গুরু’।
আরও পড়ুন: ঢাকার বাতাসের উন্নতি
অভিনয়ের প্রায় সব গলিতে তার বিচরণ ছিল। আশি ও নব্বইয়ের দশকে মঞ্চ ও টিভি নাটককে জনপ্রিয় করার পেছনে হুমায়ূন ফরীদির অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে গেছেন তিনি। এখনও তিনি সবার হৃদয়ে জায়গা করে আছেন। ভক্তদের ভালোবাসায় তিনি একজন অমর অভিনেতা।
১৯৬৪ সালে মাত্র ১২ বছর বয়সে কিশোরগঞ্জের মহল্লার নাটক ‘এক কন্যার জনক’-এ প্রথম অভিনয়ে করেন হুমায়ূন ফরিদী।
আরও পড়ুন: নতুন রূপে সালমানের আত্মপ্রকাশ
১৯৭৬ সালে নাট্যজন সেলিম আল দীন-এর উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় নাট্যোৎসব। ফরিদী ছিলেন এর অন্যতম প্রধান সংগঠক। এই উৎসবে ফরিদীর নিজের রচনায় এবং নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় ‘আত্মস্থ ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক। ওই সময় নাটকটি সেরা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। ‘হুলিয়া’ দিয়ে প্রথম সিনেমাতে অভিনয়। ফরিদী অভিনয়ে এতোটাই অনবদ্য ছিলেন যে একসময় নায়কের চেয়ে বাংলা সিনেমাপ্রেমী জাতির কাছে ভিলেন হুমায়ূন ফরিদী বেশি প্রিয় হয়ে ওঠেন।
আতিকুল ইসলাম চৌধুরীর ‘নিখোঁজ সংবাদ’র মধ্য দিয়ে টিভি পর্দায় আগমন তার। তবে ১৯৮৩ সালে সেলিম আল দীনের রচনা এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর পরিচালনায় সেই সময়কার জনপ্রিয় নাটক ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’তে টুপি দাড়িওয়ালা গ্রামের মিচকা শয়তান সেরাজ তালুকদারের যে চারিত্রিক রূপ তিনি দিয়েছিলেন আর সেই নাটকে তার সেই সংলাপ ‘আরে আমি তো পানি কিনি, পানি, দুধ দিয়া খাইবা না খালি খাইবা বাজান’ বেশ শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো। শুধু তাই নয়, আধুনিক এই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়াতেও ঘুরে বেড়ায় হুমায়ুন ফরীদির অনেক কথা। তেমন কয়েকটি কথায় চোখ বুলানো যাক…
আরও পড়ুন: মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছি
মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হুমায়ুন ফরীদি বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর মতো এতো স্নিগ্ধ, এতো গভীর সুন্দর আর কিছু নেই। কারণ মৃত্যু অনীবার্য, তুমি যখন জন্মেছো তখন মরতেই হবে। মৃত্যুর বিষয়টি মাথায় থাকলে কেউ পাপ করবে না। যেটা অনীবার্য তাকে ভালোবাসাটা শ্রেয়।’
প্রেম নিয়ে হুমায়ুন ফরীদির সীমাহীন মুগ্ধতা ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রেমে পড়ার মতো এত আনন্দনায়ক কিছু কি আছে পৃথিবীতে? আমি এখনো একটা মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসি। নাম বলা ঠিক হবে না, ওর ক্ষতি হবে।’
হুমায়ুন ফরীদির কাছে প্রেমের সংজ্ঞাও ছিল চমৎকার। তার ভাষ্য ছিল, ‘প্রেম হচ্ছে স্বর্গীয়। প্রেমের যে অনুভূতি, এটা পবিত্র এবং স্বর্গীয়। প্রেমের চেয়ে ভালো বিষয় মানব ইতিহাসে নেই। আমি শুধু মানুষে মানুষে প্রেমের কথা বলছি না। একটা মানুষ বৃক্ষের সঙ্গে প্রেম করতে পারে, একটা মানুষ তার বাসার জানালার পাশে যে গাছটি আছে, সে গাছে যে দোয়েল পাখিটি বসে, ওই পাখির প্রেমেও পড়তে পারে। সাধারণত আমরা প্রেম বলতে বুঝি, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে এরকম না। যেমন আমাদের নবীর সঙ্গে আল্লাহ্র প্রেম, এটাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবে? এটাকে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব না। এটাকে শুধু হৃদয় থেকে অনুভব করতে হবে। প্রেম হচ্ছে এরকম।’
আরও পড়ুন: ফের এক ছাদের নিচে শাকিব-অপু!
প্রেম বলতে সাধারণ ভাষায় যেটা বোঝানো হয়, সেই প্রেম হুমায়ুন ফরীদির জীবনে প্রথম এসেছিল কৈশোরে। এ বিষয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘তখন আমার বয়স ১৪-১৫ বছর। প্রেমে পড়লাম এক গার্লস স্কুলের ম্যাডামের। যার বয়স আমার চেয়ে ২০ বছর বেশি। ওটা আমার প্রথম পড়া। এরপর বহুবার প্রেমে পড়েছি। প্রেমে পড়ার মতো আনন্দ বোধহয় আর কিছুতে নেই। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, কাউকে আঘাত দিয়ে প্রেমে পড়ার মতো গর্হিত কাজ পৃথিবীতে নেই।’
ভালোবাসা নিয়ে হুমায়ুন ফরীদির আরেকটি কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়ায়। তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি যখন কাউকে ভালোবাসবে, এক বুক সমুদ্র নিয়ে ভালোবাসতে হবে। তা নাহলে সে প্রেমের কোনো অর্থ নেই।’
বাঙালির মধ্যবিত্ত সামাজিক জীবনধারাকে তিনি আনন্দিত করে তুলেছিলেন, ফরিদীর নাটক মানেই বিটিভির সাদাকালো পর্দায় পুরো বাঙালির চোখ আটকে যাওয়া। হতাশ করতেন না তিনি, এতো প্রাণবন্ত, এতো জীবন্ত, যেন আমাদের চারপাশের মানুষগুলোই জীবন্ত হয়ে যেত ফরিদীর অভিনয়ে!
আরও পড়ুন: ফোনে বানানো সিনেমা কুড়াচ্ছে প্রশংসা
টিভি নাটকে হুমায়ুন ফরীদি আলোচনায় আসেন শহিদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল মামুন নির্মিত ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিক নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। নাটকটিতে কানকাটা রমজান চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ প্রশংসা অর্জন করেন হুমায়ুন ফরীদি। এরপর দীর্ঘ সময় তিনি ছোটপর্দায় সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেছেন।
তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটক ‘শকুন্তলা’, ‘ফণীমনসা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘মুন্তাসির ফ্যান্টাসি’, ‘কেরামত মঙ্গল’ প্রভৃতি। ১৯৯০ সালে নিজের পরিচালনায় ‘ভূত’ দিয়ে শেষ হয় ফরীদির ঢাকা থিয়েটারের জীবন।
আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’ ফরীদির অভিনীত প্রথম টিভি নাটক। তাঁর অন্য নাটকগুলোর মধ্যে ছিলো ‘সংশপ্তক’, ‘হঠাৎ একদিন’, ‘একটি লাল শাড়ি’, ‘নীল নকশার সন্ধানে’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘কাছের মানুষ’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘মোহনা’, ‘ভবেরহাট’, ‘জহুরা’, ‘আবহাওয়ার পূর্বাভাস’ ইত্যাদি।
ফরীদির প্রথম সিনেমায় অভিনয় শুরু হয় তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’র মধ্য দিয়ে। এরপর, তার অভিনীত সিনেমার মধ্যে রয়েছে ‘সন্ত্রাস’, ‘বীরপুরুষ’, ‘দিনমজুর’, ‘লড়াকু’, ‘দহন’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘কন্যাদান’, ‘আঞ্জুমান’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’ প্রমুখ। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কয়েক ডজন টিভি নাটকে অভিনয় করে গেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: আমার বড়লোক বয়ফ্রেন্ড ছিল না!
পৃথিবীর চিরায়ত নিয়মের অংশ হয়ে হুমায়ুন ফরীদি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু কর্মময় জীবনে তিনি যে অনিন্দ্য সব কাজ উপহার দিয়ে গেছেন, সেটা থেকে যাবে অনন্তকাল। আর যে কথাগুলো বলে গেছেন, তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে যাবে বিশুদ্ধ বাতাসের মতো।
সান নিউজ/এনকে