সৈয়দ জাফরান হোসেন নূর : বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ঢাকাই সিনেমার ভার্সেটাইল অভিনেতা অমিত হাসানের ক্যারিয়ার যাত্রা নায়ক হিসেবেই শুরু হয়েছিল। পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন নায়ক হিসেবেই বেশি। টানা দুই যুগের বেশি নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন : জায়েদ খানকে অমিত হাসানের ওপেন চ্যালেঞ্জ
অভিনয় যার হৃদয়জুড়ে সে-তো যেকোনো চরিত্রের অভিনয়েই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম। এরই ধারাবাহিকতায় খলনায়ক চরিত্রের অভিনেতা হিসেবেও পেয়েছেন সফলতা।
শুধু তাই নয় এই গুণী অভিনেতা অভিনয় ও প্রযোজনার পাশাপাশি পরিচালক ও গীতিকার হিসেবেও খাতায় নাম লিখিয়েছেন।
১৯৬৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত বানিয়ারা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন খন্দকার সাইফুর রহমান (অমিত হাসান)।
৫ ভাইবোনের মধ্যে ভাইদের মধ্যে তিনি সবার বড়। মাতা- মোসাম্মৎ মালিহা রহমান এবং পিতা-খন্দকার সাইদুর রহমান (ম্যাথন)। কলেজে পড়াকালীন তার এক বান্ধবী তার নাম দেন 'অমিত হাসান'।
অমিত হাসানের পিতা খন্দকার সাইদুর রহমান স্কুল জীবনে ও পরবর্তীকালে টাঙ্গাইলের কৃতি ফুটবলার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বিদ্যোৎসাহী ছিলেন।
তার দাদা খন্দকার আজিজুর রহমান হীরা (বিএ, বিএল অ্যাডভোকেট) বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার মধ্যে একজন কৃতি আইনজীবী ছিলেন। তিনি তৎকালীন টাঙ্গাইল মহকুমার একজন সুযোগ্য আইনজীবী ও দয়ালু মানুষ হিসেবে গ্রামের গরিব মক্কেলদের কাছে প্রিয় ও সুপরিচিত ছিলেন।
বৃটিশ আমলে টাঙ্গাইল টাউনে মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম “বানিয়ারা লজ" নামে দোতলা দালান নির্মাণ করেন। তৎকালীন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা পরিষদের সম্মানিত সদস্য মনোনীত হন তিনি। মহেড়ার জমিদার গীরেন চৌধুরীকে ভোটে পরাজিত করে তিনি মেজরিটি হিন্দুভোটে টাঙ্গাইল পৌরসভার দুই দুই বার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং পাকিস্তান আমলেও তিনি টাঙ্গাইল পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন।
শিক্ষা জীবন :
অমিত হাসান টাঙ্গাইলের বিখ্যাত বিন্দুবাসীনি উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি ও সরকারি মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ, কাগমারি হতে এইচএসসি এবং করটিয়ার বিখ্যাত সরকারি সা’দত কলেজ হতে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন।
অভিনয় এবং ক্যারিয়ার :
১৯৮৬ সালে 'নতুন মুখের সন্ধানে' প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সম্পৃক্ত হন অমিত হাসান।
১৯৯০ সালে ছটকু আহমেদ পরিচালিত ‘চেতনা’ সিনেমার মাধ্যমে রুপালী পর্দায় তার অভিষেক ঘটে। তখন তিনি সাইফুর নামে চলচ্চিত্রে কাজ করতেন।
`অমর সঙ্গী` ছবিতে সাইফুর রহমান থেকে নাম পরিবর্তন করে `অমিত হাসান` হয়ে যান। `জ্যোতি` ছবি দিয়ে চিত্রনায়ক হিসেবে তার রুপালি পর্দায় অভিষেক ঘটে।
একক নায়ক হিসেবে তিনি প্রথম অভিনয় করেন মনোয়ার খোকনের জ্যোতি চলচ্চিত্রে এবং এই ‘জ্যোতি’ সিনেমার মাধ্যমে পান সফলতা। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এই দশকেই তিনি শেষ ঠিকানা, জিদ্দী, আবিদ হাসান বাদলের বিদ্রোহী প্রেমিক (১৯৯৬) ও তুমি শুধু তুমি (১৯৯৭), নায়ক রাজ রাজ্জাকের বাবা কেন চাকর (১৯৯৭), শিল্পী চক্রবর্তীর রঙিন উজান ভাটি (১৯৯৭), মোতালেব হোসেনের ভালবাসার ঘর (১৯৯৮) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এ ছাড়াও তিনি একের পর এক ‘আত্মসাৎ’, ‘আত্মত্যাগ’, ‘তুমি শুধু তুমি’, ‘হিংসা’ও ‘ভুলোনা আমায়’এর মতো ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন। এসব চলচ্চিত্রে তার বিপরীতে চিত্রনায়িকা মৌসুমী, শাবনূর, শাহনাজ ও পপি অভিনয় করেন।
দাম্পত্য ও সংসার জীবন :
অমিত হাসানের স্ত্রীর নাম লাবণ্য। স্ত্রী লাবন্য কে নিয়ে সুখের সংসার গড়েছেন।
দুই কন্যা সন্তানের পিতা খন্দকার সাইফুর রহমান । বড় মেয়ে লামিসা রহমান এবং ছোট মেয়ের নাম নামিরা রহমান সামান্তা।
কর্মজীবন :
এই গুণী অভিনেতা তার দীর্ঘ প্রায় ৩৫ বছরের ক্যারিয়ারে কঠোর পরিশ্রম, দক্ষতা, যোগ্যতা, একাগ্রতা এবং ভক্তবৃন্দের ভালবাসা-দোয়ায় প্রায় ৩০০ চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন। বর্তমানে অভিনয়ের পাশাপাশি নির্মাণেও মনোযোগী হচ্ছেন এই জনপ্রিয় অভিনেতা।
২০০৮ সালে অমিত হাসান প্রযোজকের খাতায় নাম লেখান এবং টেলিভিউ নামে একটি প্রযোজনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংস্থা থেকে প্রযোজিত প্রথম চলচ্চিত্র “কে আপন কে পর”। শাহীন-সুমন পরিচালিত চলচ্চিত্রটি ২০১১ সালে মুক্তি পায়। এতে তিনি নিজেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন এবং তার বিপরীতে ছিলেন অপু বিশ্বাস।
এছাড়া ছবিতে আরও অভিনয় করেন আলমগীর, ববিতা, মিজু আহমেদ, মিশা সওদাগর প্রমুখ। আলমগীর ও ববিতা এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা ও অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
অমিত হাসান বর্তমানে খলনায়ক চরিত্রে অভিনয়ের প্রতি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ২০১২ সালে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নির্মিত এফডিসিকেন্দ্রিক প্রথম চলচ্চিত্র শাহীন সুমন পরিচালিত ‘ভালোবাসার রং’-এ তিনি প্রথমবার খলনায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন।
এই ছবিতে তুফান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
২০১৫ সালের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পায় তার অভিনীত ওয়াজেদ আলী সুমনের রক্ত ও শামীম আহমেদ রনির বসগিরি।
২০১৬ সালের শুরুতে মুক্তি পায় শফিক আচার্য্য পরিচালিত ভৌতিক চলচ্চিত্র মায়াবিনী। এতে তিনি মায়া চরিত্রে অভিনয় করেন। এই বছর ঈদুল ফিতরে মুক্তি পায় তার অভিনীত নবাব, বস ২ ও রাজনীতি।
বাবা যাদব পরিচালিত বস ২ ছবিতে তাকে প্রথম কলকাতার অভিনেতা জিতের সাথে অভিনয় করতে দেখা যায়। এই ছবিতে তিনি বাংলাদেশী ব্যবসায়ী প্রিন্স শাহনেওয়াজ চরিত্রে অভিনয় করেন।
অমিত হাসান অভিনীত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা হচ্ছে দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর ‘তুমি আছো তুমি নাই’। আগামী ঈদে মুক্তি পাবার কথা রয়েছে শাহীন সুমনের ‘বিদ্রোহী’ এবং শামীম আহমেদ রনির ‘বিক্ষোভ’।
এছাড়াও তিনি ব্যস্ত আছেন রকিবুল আলম রকিবের ‘সীমানা’, ‘ইয়েস ম্যাডাম’, সৈকত নাসিরের ‘মাসুদ রানা’ ও অপূর্ব রানা’র ‘যন্ত্রণা’ সিনেমার কাজ নিয়ে।
সংগঠন ও দায়িত্ব :
অমিত হাসান ২০১৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
২০২০ সালে বাংলাদেশ ফিল্ম ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি ।
এই গুণী অভিনেতা সময় পেলেই অবসরে কবিতা-গান লিখেন। তিনি প্রায় ৫০-৬০ টি কবিতা লিখেছেন। এছাড়াও শতশত গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন।
এই জনপ্রিয় শিল্পী নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার সম্পর্কে প্রায় বলে থাকেন,
`আমি শিল্পী। একজন শিল্পীর সবধরণের চরিত্রের অভিনয়ে পারদর্শিতা থাকা উচিত। ’
তথ্যসূত্র : প্রজন্ম একুশ ম্যাগাজিন, বানিয়ারা সাহিত্য পরিষদ (বাসাপ)।
সান নিউজ/এইচএন