বিনোদন ডেস্ক: পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন ভারতের তিনবারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী সুরেখা সিক্রি। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৬ জুলাই সকালে মারা যান বলিউডের এ জ্যেষ্ঠ অভিনেত্রী। মৃতু্কালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। ২০২০ সালে তাঁর ব্রেন স্ট্রোকও হয়েছিল। শেষ জীবনে এসে অর্থ কষ্টে পড়েন শক্তিমান অভিনেতা নাসিরুদ্দিনের প্রাক্তন শ্যালিকা সুরেখা সিক্রি। তার ছিলো না চিকিৎসার অর্থও।
কলেজজীবনেই প্রেমে পড়েন লেখালেখির। ইচ্ছে ছিলো হবেন সাংবাদিক কিন্তু জীবন তাকে নিয়ে গেলো ভিন্ন জগতে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর পাইলটের মেয়ে সুরেখা সিক্রি হয়ে গেলেন বলিউডের তিনবার জাতীয় পুরস্কারজয়ী অভিনেত্রী।
অবিভক্ত ভারতের দিল্লিতে ১৯৪৫ সালের ১৯ এপ্রিলে জন্ম সুরেখার। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ার পরে তিনি ভর্তি হন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায়। ভর্তির সুযোগ আসে হঠাৎ।
সুরেখার সৎ বোন ছিলেন মানারা। তাঁর শখ ছিল অভিনেত্রী হওয়ার। তিনি নিজের জন্য এনএসডি-র ফর্ম এনেছিলেন। পরে তার মত বদল হয়, পড়েন ডাক্তারি। মায়ের কথায় বাড়িতে পড়ে থাকা সেই ফর্ম ভর্তি করে আবেদন করেছিলেন সুরেখা।
তার পর পাল্টে গেলো তাঁর জীবনের গতিপথ। দিল্লি থেকে মুম্বাই আসার আগে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেন এনএসডি-র হয়ে। এনএসডি তাঁকে অভিনয় ও নাটকের খুঁটিনাটি এবং কাজের প্রতি শ্রদ্ধা শিখিয়েছিল হাতে ধরে। এসব জানিয়েছিলেন এক সাক্ষাৎকারে সুরেখা।
প্রসঙ্গত সুরেখার বোন মানারা ছিলেন ভারতের শক্তিমান অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহের প্রথম স্ত্রী। পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে বয়সে ১৪ বছরের বড়, পেশায় চিকিৎসক মানারাকে বিয়ে করেছিলেন সদ্য কুড়ির কোঠায় পা রাখা নাসিরুদ্দিন। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। পরে দু’জনেই আবার বিয়ে করেন।
নাসিরুদ্দিন এবং প্রয়াত মানারার একমাত্র মেয়ে হীবাও একজন অভিনেত্রী। তিনি থাকেন নাসিরুদ্দিন ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রত্না ও দুই সৎ ভাইয়ের সঙ্গে। সুরেখার সঙ্গেও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিলো তাঁর দিদির মেয়ের হীবার।
অভিনয় জীবনের প্রথম দেড় দশক সুরেখা শুধুমাত্র থিয়েটারে কাটান। দিল্লির মঞ্চ জগতে তার ছিলো উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম। সে সময় বহু নাটকে তিনি কাজ করেছিলেন ওম পুরী, রঘুবীর যাদব এমনকি, নাসিরুদ্দিন শাহের সঙ্গেও।
অর্থ এবং বৃহত্তর পরিচিতির জন্য সুরেখা পরে পা রেখেছিলেন সিনেমা জগতে। ১৯৭৮-এ মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কিসসা কুর্সী কা’ ছবিতে প্রথম দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
গোবিন্দ নিহালনির ছবি ‘তমস’-এ অভিনয়ের জন্য সুরেখা শ্রেষ্ঠ সহ-অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন।
১৯৯৪ সালে শ্যাম বেনেগাল পরিচালিত ‘মাম্মো’-র জন্যেও জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন সুরেখা।
তৃতীয় জাতীয় পুরস্কার আসে ২০১৮ সালের ছবি ‘বধাই হো’-র সুবাদে। কোনওদিন নায়িকা হিসেবে অভিনয় না করলেও চরিত্রাভিনয়কে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন অন্য স্তরে।
‘পরিণতি’, ‘নজর’, ‘সরদারী বেগম’, ‘সরফরোশ’, ‘দিল্লগি’, ‘জুবেইদা’, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’, ‘রেনকোট’, ‘তুম সা নহিঁ দেখা’, ‘জো বোলে সো নিহাল’ এবং ‘দেব ডি’ তাঁর কেরিয়ারের উল্লেখযোগ্য ছবি।
মূল বাণিজ্যিক এবং সমান্তরাল, দুই ধরনের ছবিতে যেসব কুশীলব জনপ্রিয় হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সুরেখা ছিলেন অন্যতম।
ছোট পর্দাতেও সুনামের সঙ্গে কাজ করেছিলেন সুরেখা। ‘বালিকা বধূ’ সিরিয়ালে তাঁর অভিনীত ‘দাদীসা’ চরিত্রটি তো ভারতীয় বিনোদনের দুনিয়ায় আইকনিক। দাদীসার শৈশবের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুরেখার বোনঝি হীবা।
২০১৯-এ মহাবালেশ্বরে শুটিংয়ের সময় ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। বেশ কয়েক মাস শয্যাশায়ী অবস্থায় অভিনয় থেকে দূরে ছিলেন সুরেখা।
তিনি হাল ছাড়েননি। সুস্থ হয়ে সই করেছিলেন পরবর্তী ছবি, জোয়া আখতারের ‘গোস্ট স্টোরিজ’-এ।
তারপর করোনা আবহে ৬৫ ঊর্ধ্ব অভিনেতাদের কাজে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল মহারাষ্ট্র সরকার। এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি সুরেখা।
সরকারের কাছে প্রবীণ অভিনেত্রীর প্রশ্ন ছিল, যদি প্রৌঢ় নেতারা কাজ করতে পারেন, তবে অভিনেতাদের বেলায় নিষেধাজ্ঞা কেন?
এর পরেই খবর ছড়িয়ে পড়েছিল, অর্থাভাবে অনুগ্রহ চাইছেন সুরেখা। স্পষ্ট ভাষায় তাঁদের প্রত্যুত্তরও দেন সুরেখা। বলেন, তিনি ভিক্ষা বা অনুগ্রহ চাননি। বরং, কাজ চেয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমে সুরেখা স্বীকার করেছিলেন চিকিৎসার ব্যয়ভার মেটাতে তাঁর অর্থ প্রয়োজন। তবে তিনি অনুগ্রহ বা সাহায্য হিসেবে সেই অর্থ চান না। সসম্মানে অভিনয় করে তাঁর পারিশ্রমিক চান। জানিয়েছিলেন, সত্তরোর্ধ্ব অভিনেত্রী। বিনীতভাবে ফিরিয়ে দিয়েছেন অর্থসাহায্যও।
সুরেখার স্বামী হেমন্ত রেগের মৃত্যু হয়েছে ২০০৯-এ। ২০২১-এ ১৬ জুলাই সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁরও। তাঁদের একমাত্র ছেলে রাহুল একজন শিল্পী।
বাইরে থেকে আপাত কঠিন, ভিতরে কোমল ভাবমূর্তি দিয়ে দীর্ঘ চার দশক দর্শকদের মুগ্ধ করে গিয়েছেন সুরেখা। তিনি নিছক অভিনেত্রী ছিলেন না। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন।