নিজস্ব প্রতিনিধি, সুনামগঞ্জ : ১৮৩৩ সালে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার কেশবপুর গ্রামে দেশের লোকসংস্কৃতির উজ্জ্বল নক্ষত্র গীতিকবি রাধারমণ দত্তের জন্ম। তিনি সামন্তবংশের প্রভাকর দত্তের দ্বাদশ পুরুষ। ১৯১৫ সালের ১০ নভেম্বর (২৬ কার্তিক) ৮৩ বছরে বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) রাধারমণ দত্তের ১০৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। রাধারমণের বাবা রাধামাধব পরম পণ্ডিত ও অশেষগুণের অধিকারী ছিলেন। বাবার সঙ্গীত ও সাহিত্য সাধনা রাধারমণকে প্রভাবিত করে। কালক্রমে তিনি একজন স্বভাবকবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। বিভিন্ন সংগ্রাহকদের মতে, রাধারমণের গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি।
‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো, আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে/কিংবা জবা কুসুম সন্ধ্যামালী আনরে তুলিয়া মনোরঙ্গে সাজাও কুঞ্জ সব সখি মিলিয়া, মুর্শিদ বলি নৌকা ছাড়ো তুফান দেখি ভয় করিও না, মুর্শিদ নামে ভাসালে তরী অকূলে ডুবিবে না/দেখলাম দেশের এই দুর্দশা, ঘরে ঘরে চোরের বাসা’ এমন গান শুনলেই বোঝা যাবে রাধারমণ দত্তের সঙ্গীত বিচিত্র বিষয়ে পরিপূর্ণ।
প্রার্থনা তো ছিলই, আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব এবং পরমাত্মাবিষয়ক সঙ্গীত ছাড়াও তার স্বদেশ প্রেমেরও অনেক গান রয়েছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং ব্যতিক্রম হচ্ছে ধামাইল গান। রাধারমণের গানে শব্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। আল্লাহ-ঈশ্বরে যেমন তিনি পার্থক্য দেখেননি, গুরু এবং মুর্শিদ শব্দের পার্থক্য দেখাননি।
তবে গীতিকবি রাধারমণ দত্ত মারা গেলেও তার ধামাইল গান এত জনপ্রিয় যে বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিনের অনুষ্ঠান এমনকি বন্ধুবান্ধবসহ সবাই এখনও ধামাইল গান বাজিয়ে ধামাইল নাচ নাচেন।
এদিকে রাধারমণ দত্তের রচিত গানগুলোর কোনো অংশ পরিবর্তন না করে সঠিক সুরে গাওয়া এবং দ্রুত রাধারমণ কমপ্লেক্সে নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের সংস্কৃতিকর্মী, বাউলশিল্পী ও তার ভক্তরা।
জেলা উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাধারমণ দত্তকে ধামাইলের জনক হিসেবে বলা হয়ে তাকে, এখনও বিয়ে কিংবা যেকোনো অনুষ্ঠানে তার গান বাজিয়ে পরিবারের সকলে মিলে ধামাইল দেয়, তাই আমাদের দাবি রাধারমণ দত্তকে নিয়ে আরও বেশি করে যেন চর্চা করা হয়।
সংস্কৃতিকর্মী আল হাবিব বলেন, আমরা তরুণপ্রজন্ম এই দাবি করি যে রাধারমণ দত্তের রচিত গানগুলোর কোনো অংশ পরিবর্তন না করে যেন সঠিক সুরে গাওয়া হয়।
সংস্কৃতিকর্মী সোহেল আহমদ বলেন, রাধারমণ দত্তের নামে দ্রুত কমপ্লেক্স নির্মাণের দাবি অনেক দিনের। আমরা মনে করি রাধারমণ কমপ্লেক্স নির্মাণ হলে সেখানে গিয়ে আগামী প্রজন্ম অনেক কিছু শিখতে ও দেখতে পারবে, তাই আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা সরকারের কাছে দাবি জানাই দ্রুত যেন এই কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়।
বাউলশিল্পী আল হেলাল বলেন, রাধারমণের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রচনাকে খুঁজে বের করে সর্বসাধারণের মাঝে তুলে ধরার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি বলে মনে করেন সুনামগঞ্জের বাউলশিল্পীরা।
সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামছুল আবেদীন জানান, বৈষ্ণবকবি রাধারমণ দত্তের প্রতিটি সৃষ্টিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তার সকল সৃষ্টি অবিকৃতভাবে সংরক্ষণের চেষ্টা চলছে। রাধারমণ দত্তের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সেই সম্পত্তি আইনী প্রক্রিয়ায় উদ্ধার করা হয়েছে এবং রাধারমণ কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে রাধারমণ কমপ্লেক্সের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। রাধারমণের স্মৃতি রক্ষায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।
সান নিউজ/পিডিকে/এস