নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের চার কোটি শিক্ষার্থীকে সুরক্ষা দিয়ে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে চায় সরকার। সবার আগে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি নিতে তৈরি করা হয়েছে নির্দেশিকা ও জারি হয়েছে নির্দেশনা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত না হলেও খোলার আগে বেশ কিছু বিধান মেনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ফের চালুর প্রস্তুতি নিতে এ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে।
তবে করোনা পরিস্থিতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দিন নির্ধারণের বিষয় নির্ভর করছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ওপরে। তাই আগামী নভেম্বরেও যদি বিদ্যালয় খোলা সম্ভব না হয়, সে বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ‘অটোপাস’ দেওয়ারও সিদ্ধান্ত রয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।
মঙ্গলবার (০৮ সেপ্টেম্বর) করোনাকালে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি শুরুর নির্দেশনা দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয় সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিদ্যালয় ফের চালু করার জাতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তিনটি ক্যাটাগরিতে ৫০টির বেশি নির্দেশনা দিয়ে নির্দেশিকাটি প্রণয়ন করা হয়। আর করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীর ক্ষতি পোষাতেও আগাম ব্যবস্থা নিয়ে রাখছে সরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ সুবিধাদি পাবে শিক্ষার্থীরা।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদ্যালয় পুনরায় চালুর নির্দেশিকা’ সব বিদ্যালয়ে পাঠাতে মঙ্গলবার (০৮ সেপ্টেম্বর) প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকে চিঠি পাঠিয়েছে।
বিদ্যালয় ফের চালু করার সিদ্ধান্ত হলে ছয়টি মাত্রা যথা— নীতিনির্ধারণ, অর্থ সংস্থান, নিরাপদে কার্যক্রম পরিচালনা, শিখন, সর্বাধিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পর্যন্ত পৌঁছানো নিশ্চিতকরণ এবং সুস্থতা/সুরক্ষা ব্যবস্থা বিবেচনা করে এই নির্দেশনা প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানায় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
পাঁচ পৃষ্ঠার ওই নির্দেশিকার আলোকে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে তাও বিস্তারিতভাবে বলে দেওয়া হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয়ক সামগ্রিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কখন বিদ্যালয় পুনরায় চালু করা যাবে, সে সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সেই অনুসারে জাতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সহায়তার উদ্দেশ্যে এই নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে বলে নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করতে এবং প্রতিটি শিশুর শিখন, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ করতে এই নির্দেশিকাটি ক্রমাগত অভিযোজন ও প্রাসঙ্গিকরণ করা প্রয়োজন হবে।
গত ৮ মার্চ দেশে করোনা রোগী শনাক্তের পর গত ১৭ মার্চ থেকে দফায় দফায় ছুটি বাড়িয়ে কওমি মাদ্রাসা বাদে দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে আগামী ০৩ অক্টোবর পর্যন্ত। বাতিল হয়েছে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা। করোনা ভাইরাসের কারণে এবার কেন্দ্রীয়ভাবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা না নিয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় সংসদ টিভি, বেতার এবং অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়।
ছুটির পর পরিস্থিতি অনুকূলে এলে বিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে। তবে কবে নাগাদ খোলা যাবে, তা নির্ভর করছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ওপরে। এ প্রেক্ষাপটে যদি নভেম্বরেও বিদ্যালয় না খোলা সম্ভব হয়, তখন কি হবে, সে সিদ্ধান্তও নিয়ে রেখেছে সরকার। সেক্ষেত্রে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা অটো পাস দেওয়া হবে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এ কারণে মঙ্গলবার আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় বিদ্যালয় খোলা নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর কারণে সারা পৃথিবী এই আক্রান্ত হয়েছে। অফিস, আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিপূর্ণভাবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পরিবেশ হয়নি। তারপরেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সরকারি অফিসগুলো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কলকারখানাগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের লেখাপড়ার পরিবেশ আর অভিভাবকদের আপত্তি আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে।
নভেম্বরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা না গেলে প্রাথমিকের সব শ্রেণিতেই ‘অটোপাস’ দিতে হবে। কারণ, ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রম শেষ হবে। আর এই সময়ে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসও শেষ করা সম্ভব হবে না। সে কারণে মূল্যায়নও সম্ভব নয়। ফলে অটোপাস ছাড়া কোনও বিকল্প থাকছে না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ মার্চ থেকে আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এই ছুটির পর আগামী ৪ অক্টোবর প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা সম্ভব হলে আগামী ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রেণি কার্যক্রমের জন্য সময় থাকছে মাত্র ৭৬ দিন। আর নভেম্বরের শুরুতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হলে শ্রেণি কার্যক্রমের জন্য সময় থাকছে মাত্র ৪০ দিন। এই সময়ের মধ্যে সংক্ষিপ্ত সর্বশেষ দুটি লেসন প্ল্যান অনুসারে সিলেবাস শেষ করা সম্ভব। যদি নভেম্বরে বিদ্যালয় খোলা যায়, তাহলে নিজ নিজ বিদ্যালয়ে মূল্যায়ন করা যাবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে মূল্যায়নেরও সুযোগ থাকছে না।
আর ডিসেম্বরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হলেও খোলার পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বিদ্যালয়ে নিতে হবে। সেক্ষেত্রেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৫ দিন সময় লাগবে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে। সেই হিসেবে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় থাকে মাত্র চারদিন। এ সময়ের মধ্যে এ বছরে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নও সম্ভব হবে না। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির ওপর।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন বলেন, ‘আমরা অক্টোবর ও নভেম্বরকে টার্গেট করে দুটি লেসন প্ল্যান তৈরি করেছি। যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা সম্ভব হয়, তাহলে আমরা অক্টোবরের লেসন প্ল্যান নিয়ে কাজ করবো। সেক্ষেত্রে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা ৭৬ দিন সময় পাবো। অক্টোবরে খোলা না গেলে নভেম্বরে আমরা একটি লেসন প্ল্যান অনুমোদন করে রেখেছি। এক্ষেত্রে ১৯ ডিসেম্বরের ৪০ দিন সময় পাবো ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা করানোর জন্য। সেটি যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে আমরা মূল্যায়নের ব্যবস্থা করতে পারবো। আর যদি স্কুল খোলা না যায় (নভেম্বরে) তাহলে প্রধানমন্ত্রী যেটি বলেছেন, আমাদের অটোপাস ছাড়া উপায় নেই। ’
সিনিয়র সচিব আরও বলেন, ‘যদি স্কুল খোলা যায়, আর পরবর্তী লেসন প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পারি, সেক্ষেত্রে মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। সবকিছু নির্ভর করছে স্কুল খোলার ওপর।’
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সব বিষয় মাথায় রেখে গত ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (ইইসি) না নেওয়ার প্রস্তাবনা পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর গত ২৫ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে ফাইল পৌঁছে। ওইদিনই মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, পিইসি ও সমমান পরীক্ষা কেন্দ্রীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হবে না। স্ব স্ব বিদ্যালয় নিজেরা নিজেদের মতো করে পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করবে।
মন্ত্রণালয়ের জরিপ অনুসারে, কোভিড-১৯ ভাইরাসের প্রভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গত ১৭ মার্চ থেকে আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধ। এতে ৭১ কার্যদিবস বিদ্যালয় বন্ধ থাকবে। সে কারণে পঞ্চম শ্রেণির ৪০৬টি স্বাভাবিক পাঠদান সম্ভব হবে না। আর গত ১৭ মার্চ পর্যন্ত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পাঠদান সম্পন্ন হয়েছে শিক্ষার্থীদের। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রাথমিক ও ইবতেদায়ির শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে না।
পাশাপাশি প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মূল্যায়নের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হবে। তবে পুরো বিষয়টি কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে তা নির্ভর করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও করোনার পরিস্থিতি অনুযায়ী। সর্বশেষ গত রোববার (০৬ সেপ্টেম্বর) মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ব্যাখ্যাসহ জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না গেলে বার্ষিক মূল্যায়ন সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে অটোপাস করাতেই হবে শিক্ষার্থীদের।
তারপরও প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি শুরুর নির্দেশিকায় অবকাঠামো এবং শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিবেচনা করে একাধিক শিফট কিংবা সপ্তাহের একেকদিন একেক শ্রেণি বা একাধিক শ্রেণির পাঠদানের ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা দিয়ে রাখা হয়েছে। কবে কোন শ্রেণির ক্লাস হবে তা ঠিক করবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এতে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। আর পাঠ পরিকল্পনায় পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
নির্দেশিকায় বলা হয়, ‘বিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু, সমাপ্তি ও মিড-ডে মিলের সময়সূচি এমনভাবে সাজিয়ে নিতে হবে, যেন শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের জটলা না তৈরি হয়। বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ও শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিবেচনা করে একাধিক শিফট কিংবা সপ্তাহের একেকদিন একেক শ্রেণির বা একাধিক শ্রেণির পাঠদানের ব্যবস্থা রেখে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্থানীয়ভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন, যেন শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যায়। পাঠ পরিকল্পনায় পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মাঠ পর্যায়ে উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তারা পরিকল্পনার অনুমোদন করবেন এবং উপজেলা/থানা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টারের বিদ্যালয়গুলোর পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা ও বাস্তবায়নের তদারকি করবেন।
প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি নির্দেশিকায় আরো বলা হয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ও কর্মচারীদের সার্বক্ষণিক হাত ধোয়ার বিষয়টি নিশ্চিতে পর্যাপ্ত নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে। হাত ধোয়ার সময় যেন শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের জটলা না তৈরি হয়, সেভাবে বিদ্যালয়ভিত্তিক পানির ট্যাপের অবস্থান ও সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে।
সান নিউজ/ এআর