নিজস্ব প্রতিবেদক:
আগামী মাসের শুরুর দিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এর অংশ হিসেবে করোনাকালে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ফের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতি শুরুর নির্দেশনা দিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৪ কোটি শিক্ষার্থীর ক্ষতি পোষাতেও আগাম ব্যবস্থা নিয়ে রাখছে সরকার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ সুবিধাদি পাবে শিক্ষার্থীরা।
মঙ্গলবার (০৮ সেপ্টেম্বর) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব শামীম আরা নাজনীন স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত নির্দেশনায় বিদ্যালয় ফের চালুর আগে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত অনুমোদিত নির্দেশিকার আলোকে প্রস্তুতি শুরু করতে বলা হয়েছে।
গত ৮ মার্চ দেশে করোনা রোগী শনাক্তের পর গত ১৭ মার্চ থেকে দফায় দফায় ছুটি বাড়িয়ে কওমি মাদ্রাসা বাদে দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে আগামী ০৩ অক্টোবর পর্যন্ত। বাতিল হয়েছে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা। ছুটির পর পরিস্থিতি অনুকূলে এলে বিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে। তবে কবে নাগাদ খোলা যাবে, তা নির্ভর করছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ওপরে।
শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে শিক্ষাজীবন ব্যহত হচ্ছে দেশের ৪ কোটি শিক্ষার্থীর। এই ক্ষতি পোষাতে নানা উদ্যোগ ও আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে সরকার। এর মধ্যে নতুন শিক্ষাবর্ষে বিদ্যালয়ে ভর্তি, শিক্ষার্থী মূল্যায়নে (পরীক্ষা) ও লেখাপড়ার ক্ষতিপূরণে সহায়তা, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা দেওয়া, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবেলায় বিদ্যালয় ব্যবস্থার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা, দূরশিক্ষণ কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখা এবং বিদ্যালয়ের সঙ্গে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমকে একীভূত করা হবে।
‘বাংলাদেশ কোভিড-১৯ স্কুল সেক্টর রেসপন্স’ নামের বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে এ উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই প্রকল্পে ১৫ মিলিয়ন বা ১২৬ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিচ্ছে গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফর এডুকেশন (জিপিই)। বাংলাদেশের পক্ষে সংস্থাটির কাছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন ২০ মিলিয়ন ডলার চেয়ে আবেদনের উদ্যোগ নেন। এর বিপরীতে ১৫ মিলিয়ন বা ১২৬ কোটি টাকা দিতে সম্মত হয় সংস্থাটি। বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে টাকা ছাড় করা হবে।
জরুরি পরিস্থিতি বা দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধের পরিস্থিতিতে কৌশল ও মানসম্মত কার্যপ্রণালি প্রণয়নে সব ধরনের কারিগরি সহায়তা সেবা নিশ্চিত করা হবে প্রকল্পটির মাধ্যমে। বিদ্যালয় খোলার পর প্রায় ২০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী দেওয়া হবে। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে বিশেষ স্কিম।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন বলেন, ‘স্কুল খোলার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকল্পের মাধ্যমে সুবিধা পাবে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে যেসব নির্দেশনা তৈরি হয়েছে, তা বাস্তবায়নে অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে। এতে সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না।’
তিনি জানান, করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ফের বিদ্যালয় খুলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে। তাই নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের মাধ্যমে বিদ্যালয় ফের চালুর নির্দেশিকাটি প্রণয়ন করা হয়েছে। মঙ্গলবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এই নির্দেশিকা স্কুল পর্যায়ে পৌঁছে দিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশও দিয়েছে।
‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদ্যালয় পুনরায় চালুর নির্দেশিকা’ স্কুল পর্যায়ে পাঠানো হবে। পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদির খসড়াসহ উপস্থাপনাও দেওয়া হবে।
করোনাপরবর্তী সময়ে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে বিদ্যালয় খোলার আগে স্বাস্থ্য নিরাপত্তামূলক এমন ৫০টির বেশি নির্দেশনা জারি করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এসব নির্দেশনা মেনে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
তিনি জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপদে রেখে বিদ্যালয়ে পাঠদান পরিচালনায় করণীয় বিষয়ক নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। বিদ্যালয় খোলার আগে ও চলাকালে করণীয় বিষয়ক বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন কীভাবে ক্লাস পরিচালনা হবে, সে বিষয়ে দিক-নির্দেশনা নির্ধারণ করে আলাদাভাবে তিনটি ক্যাটাগরিতে ৫০টির বেশি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে এসব নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশ কোভিড-১৯ স্কুল সেক্টর রেসপন্স’ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দুই বছর চলবে এই প্রকল্প। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলে পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। তবে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে থাকবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে, কোভিড-১৯ সংকট মোকাবেলা এবং উত্তরণের জন্য বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত করোনা সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবেলায় শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করা, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ২৫ লাখ শিক্ষার্থীকে একীভূত দূরশিক্ষণ (টিভি, রেডিও ও অনলাইন) সহায়তা দেওয়া। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২ লাখ ৪৫ হাজার ছাত্র এবং ১২ লাখ ৯৫ হাজার ছাত্রী রয়েছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণে ৩২ লাখ ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের সরকারি বিদ্যালয়ে পুনঃভর্তি (যারা চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছিল) নিশ্চিত করা হবে। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৯০ হাজার ছাত্র ও ১৬ লাখ ৫০ হাজার ছাত্রী রয়েছে।
বিদ্যালয় ব্যবস্থার সঙ্গে দূরশিক্ষণ কার্যক্রমকে পুরোপুরি কার্যকর ও একীভূত করা হবে প্রকল্পের মাধ্যমে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণির পুরো শিক্ষাবর্ষের জন্য পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ ডিজিটাল কনটেন্ট সমৃদ্ধ ৩৫টি বিষয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। দুর্গম এলাকার এক লাখ ৫০ হাজার শিশুকে শিক্ষা উপকরণ দেওয়া হবে। স্কুল বন্ধ থাকায় ১৫ লাখ শিশু-শিক্ষার্থীকে করোনার নেতিবাচক প্রভাব থেকে উত্তরণ ঘটাতে প্রচারণা চালানো হবে।
নিরাপদ বিদ্যালয় খোলার পরিকল্পনা অনুসারেই ২০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় ফের খোলা হবে। শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল তৈরি, বিদ্যালয় বন্ধের কারণে শিক্ষার ক্ষতি পরিমাপ করতে তিন লাখ ৫০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। এছাড়া দুই লাখ শিক্ষককে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
করোনার সংকটে যেসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, তাদের আবার স্কুলে ভর্তিতে সহায়তা করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে (পরীক্ষা) ও লেখাপড়ার ক্ষতি পূরণে সহায়তা করা এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সেবা দেওয়া হবে। সব কার্যক্রমের কারিগরি সহায়তা সেবা নিশ্চিত করা হবে প্রকল্পটি থেকে।
বিদ্যালয় ব্যবস্থার জন্য মানসম্মত জরুরি পরিচালনা কার্যপ্রণালি তৈরি করা এবং শিখন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সরাসরি ইন্টারভেশন থেকে তিন কোটি ৫৯ লাখ শিক্ষার্থী উপকৃত হবে। অসম পঠন-পাঠন সমস্যার সমাধান করাও হবে এই প্রকল্পের একটি কার্যক্রম।