জেলা প্রতিনিধি, পাবনা: তরুণ ও উঠতি বয়সী শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন ও মাদকের নেশা থেকে আলোর পথে ফেরাতে পাবনার বেড়ায় গড়ে উঠেছে তিন চাকার ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার।
আরও পড়ুন: ডিগ্রি নিয়েও বেকার থাকছে তরুণরা
‘শিক্ষার্থী সহযোগিতা’ নামক সামাজিক সংগঠনের তৈরি এমন উদ্যোগ প্রশংসা কুড়াচ্ছে। উপজেলা জুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। শিক্ষার্থীরা উৎসবমুখর পরিবেশে পাঠাগারের বই পড়ছে।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সবুর আলীর অর্থায়নে নির্মিত ব্যতিক্রমী এই শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠনের ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারটি এক স্কুলে ৭ দিন রেখে আরেক স্কুলে পাঠানো হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা চাহিদা অনুযায়ী পছন্দের বই নিয়ে যাচ্ছে। ছুটির পরে সেগুলো আবার পাঠাগারে জমা দিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ভিসির সাথে ‘মুজিব’ দেখলেন ঢাবির ৫০০ শিক্ষক
আয়োজকদের থেকে জানা গেছে, গত আগস্ট মাসের ১৭ তারিখ দুপুরের দিকে প্রায় ৭০০ বই নিয়ে পথ চলা শুরু করে পাঠাগারটি, যা তিন চাকা বিশিষ্ট একটি ভ্যানে নির্মিত হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারটিতে গল্প, উপন্যাস, ছোটগল্প, ইসলামিক, শিশুতোষ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক, বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীসহ বিভিন্ন ধরনের বই রয়েছে।
৭ দিন করে উপজেলার এক একটি স্কুলের সব শিক্ষার্থীদের জন্য উম্মুক্ত থাকবে। সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এর দায়িত্বে থাকবে। স্কুলের টিফিনের সময় খোলা হয়। শিক্ষার্থীরা টিফিনের সময় হলেই চলে আসে এবং পাঠাগার থেকে পছন্দ মতো বই নিয়ে যায় ক্লাসে।
আরও পড়ুন: মনপুরা মনোয়ারা বেগম কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠিত
টিফিন শেষ হওয়ার ঠিক ৫-১০ মিনিট আগে বইগুলো জমা দিয়ে যেতে হয়। ক্রমে ক্রমে শিক্ষাথীরা খাতায় নাম-ঠিকানা লিখে এসব বই বাড়িতে নিয়ে পড়ার সুযোগও পাবে।
সরেজমিনে উপজেলার বেড়া স্কুল এন্ড কলেজে দেখা গেছে, স্কুলের একপাশে ৩ চাকা বিশিষ্ট একটি ভ্যানে নির্মিত পাঠাগার দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে র্যাক সিস্টেম করে বিভিন্ন ধরনের বই সাজানো রয়েছে।
টিফিনের সময় শিক্ষার্থীরা এসে তাদের পছন্দ মতো বই নিয়ে পাঠাগারের চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে পড়ছে। আবার কেউ ভবনের বারান্দায় বসেই বই পড়ছে। অনেককে শ্রেণিকক্ষে নিয়ে বই পড়তে দেখা গেছে।
আরও পড়ুন: স্কুলেই রান্না শিখছে শিক্ষার্থীরা
প্রতিদিন প্রায় ৫০-৬০ জনের মত শিক্ষর্থীরা ভ্রাম্যমাণ এ পাঠাগারের বই পড়েন। ক্রমে বই পড়ার শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বাড়বে বলে জানান আয়োজকরা।
বেড়া স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহাদ সরকার বলেন, স্কুলে কয়েক দিন আগে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারটি নিয়ে আসা হয়েছে। বর্তমানে আমি দায়িত্বে রয়েছি। এ সপ্তাহে আমাদের স্কুলে পাঠাগারটি থাকায় টিফিনের সময় হলে আমি পাঠাগারটি খুলে দেই।
তারপর সবাই সবার পছন্দের বই সংগ্রহ করে পড়া শুরু করে। এতে দেখা যাচ্ছে, সবাই গল্প করে সময় নষ্ট না করে বই পড়ছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন তথ্য ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এমন উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। বিষয়টি দেখে রাখার দায়িত্ব পাওয়ায় ভালো লাগছে।
আরও পড়ুন: মোরেলগঞ্জে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জনবল সংকট
একই স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রেজোয়ান রাজ বলেন, আগে আমরা গল্প করে ও মোবাইল ব্যবহার করে বা আড্ডায় টিফিনের সময় কাটাতাম। স্যাররা ক্লাসে আসতে দেরি করলে ওই সময়ও অযথা কাটাতাম।
কিন্তু স্কুলে পাঠাগারটি আসার পর থেকে সেই সময়টুকু বই পড়ে কাটাচ্ছি। ভালই লাগছে। উৎসবমূখর পরিবেশ আমরা বই পড়ছি। স্কুলে স্থায়ীভাবে একটি পাঠাগার হলে ভালো হতো।
বেড়া বিপিন বিহারি উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আবু সালেক বলেন, পড়ার ফাঁকে অবসর সময় মোবাইল ব্যবহার করে বা বাইরে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতাম। আমরা অন্যপথে যাচ্ছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে।
আরও পড়ুন: আজ নবমী, দেবীর ‘মহা আরতি’
এখন পাঠাগার থেকে বই বাড়িতে নিয়ে অনেক কিছু শিখছি। বাইরে অযথা সময় নষ্ট না করে বই পড়ি। কয়েকদিন হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অজানা তথ্য জেনেছি। আরও অনেক সাহিত্যের বই পড়া শুরু করেছি।
শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠনের উপদেষ্টা, বেড়া মনজুর কাদের মহিলা ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক ও সাংবাদিক বরুণ রায় বলেন, শিক্ষার্থী সহযোগীতা সংগঠন যে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার করেছে, এটা সত্যিই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বর্তমানে খুব সাড়া ফেলেছে।
টিফিনে টাকা বাঁচিয়ে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ব্যয় করা সংগঠন যে কাজটি করে যাচ্ছে, এটা স্পষ্ট শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ পাঠাগারের কারণে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এ সংগঠন মানব সেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: হানিফ সংকেত’র জন্মদিন
শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মেহেরাব হোসেন (জিম) বলেন, টিফিনের টাকা জমিয়ে ভালো কিছু করার লক্ষ্যে আমরা ২০১৬ সালের দিকে পথচলা শুরু করেছিলাম। এখন অনেকেই আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। মানব সেবার পরিধি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের অনুপ্রেরণায় আমরা অনেক দূর আগাতে চাই।
সেটার আলোকেই আমরা ব্যতিক্রমী ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারটি করেছি। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন ও ভালো মানুষ তৈরিতে পাঠাগারের বিকল্প নেই। টিফিনের সময় প্রতিটা শিক্ষার্থীর সময় কাটুক বইয়ের সাথে।
এছাড়া শিক্ষার্থীদের খারাপ কাজ, মাদকের নেশা, মোবাইল গেমিং থেকে দূরে রাখতে আমাদের এ আয়োজন। বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব সবুর আলী স্যারের সহযোগিতায় আমাদের ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের উদ্যোগ নেয়া।
আরও পড়ুন: পর্যটকদের সেন্টমার্টিন ছাড়ার নির্দেশ
বেড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাঃ সবুর আলী বলেন, এমন একটি উদ্যোগ নিতে পেরে খুবই আনন্দ লাগছে। ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারটি উপজেলা জুড়ে ব্যাপক আলোড়না সৃষ্টি করেছে। আগ্রহ উদ্দীপনা বেড়ে যাওয়ায় সামনের মাসে আরও একটি ভ্রাম্যমান পাঠাগার তৈরি করা হবে।
তিনি আরও বলেন, এক সময় একাডেমিক লেখাপড়ার পাশাপাশি গল্পের বই পড়ে অথবা খেলাধুলা করে সময় কাটালেও বর্তমানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্মার্টফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সেজন্য নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে বই পড়ানোর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করতে হবে।
পাবনা জেলা গণগ্রন্থাগারের সহকারী লাইব্রেরিয়ান মো. এনামুল হক বলেন, বেড়য় শিক্ষার্থীদের পড়ার জন্য ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের বিষয়টি আমরা জেনেছি। যদিও আমাদের সঙ্গে এর সংশ্লিষ্টতা নেই। তবুও এটা আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি।
আরও পড়ুন: ভূমিকম্পে কাঁপল মিয়ানমার
বর্তমানে সারা দেশেই বেসরকারিভাবে পাঠাগার স্থাপনের সুযোগ হয়েছে। সেখানে সরকারিভাবে সহযোগিতার সিস্টেম রয়েছে। জেলা শহরের একটি পাঠাগারের মাধ্যমে গ্রাম পর্যায়ের মানুষ তেমন বই পড়তে পারে না। যেহেতু সেখানে তারা পাঠাগার তৈরি করেছে, তাহলে সেখানকার মানুষজন বই পড়ার সুযোগ পাবে।
এটা সত্যিই ভালো লাগছে যে, তারা ব্যক্তি উদ্যোগে এমন কাজ হাতে নিয়েছেন। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ছেলেমেয়েরা বই পড়তেই চায় না। গ্রামে আলো ছড়ানোর এমন উদ্যোগ নেওয়ায় খুব ভাল লাগছে। আমরা এর সফলতা কামনা করছি।
আরও পড়ুন: ১ নভেম্বর থেকে স্মার্টকার্ড বিতরণ বন্ধ
আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। তারা যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাহলে সরকারিভাবে নিবন্ধন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। যাতে সরকারিভাবে সুযোগ সুবিধা পায়।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের মার্চ মাসে পাবনার বেড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বেড়া বিপিন বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ৭/৮ শিক্ষার্থী সিদ্ধান্ত নেয় টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তা মানবকল্যাণে কাজে লাগাবে। সেই থেকে এর যাত্রা শুরু।
এক পর্যায়ে ওদের সঙ্গে যোগ দেয় বেড়া পৌর এলাকার আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। সবাই মিলে গঠন করে ‘শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠন’ নামের একটি মানব কল্যাণমুখী সংস্থা।
সান নিউজ/এনজে