বদরুল ইসলাম বিপ্লব, ঠাকুরগাঁও: সরকারের আর্থিক অনুদানের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজেদের অর্থে মনোরম শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলা ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবার দেশসেরা নির্বাচিত হয়েছে।
আরও পড়ুন: গুলিস্তানে বিস্ফোরণে নিহত বেড়ে ১৮
প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য স্বীকৃতিস্বরুপ শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে নির্বাচন করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। আগামী ১২ মার্চ ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ ২০২৩ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান শিক্ষকের হাতে পদক তুলে দেবেন।
সরজমিনে বিদ্যালয়টি ঘুরে দেখা গেছে, চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয় স্কুল নয় একটি শিশুপার্ক।বিদ্যালয়টি চতুর্দিক প্রাচীর ঘেরা। শিশুদের বিদ্যালয় মুখি করতে শ্রেনীকক্ষের ভেতরে ও বাইরে এবং প্রাচীর জুড়ে অংকন করা হয়েছে শিক্ষনীয় ছবি ,বর্ণ ও মনিষীদের বানী । ছড়া, কবিতা, বাণী ইত্যাদি দিয়ে পাঠদান উপভোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে বিদ্যালয়টি। মুষ্ঠির চাল ও নিজেদের অর্থে মিড-ডে মিল পরিচালনাসহ বসানো হয়েছে পার্কের মতো অসংখ্য খেলনা, দোলনা, স্লিপার, হাঁস। সবজী বাগান, হাঁস মুরগীর খামার, মাছ চাষ করে শিশুদের খাওয়ার তরকারি সরবরাহ করা হয় বিদ্যালয় থেকেই।
আরও পড়ুন: নাশকতা কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে
২০১১ সালে বাঁশের বেড়া দিয়ে ধানক্ষেতের জেলা হরিপুর উপজেলার সীমান্তঘেঁষা গ্রাম সিংহারী গ্রামে স্থাপন করা হয় চরভিটা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শুরুর দিকে বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করা হয় শিক্ষার্থী। আন্তরিকতার সঙ্গে পাঠাদান করায় ফলাফল ও প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক বৃত্তি পাওয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যে পাল্টে যায় বিদ্যালয়ের চিত্র। বেড়ে যায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার বৃদ্ধি ও পড়াশুনায় মনোযোগী করতে ২০১৪ সালে নিজ উদ্যোগে চালু করা হয় ‘মিড ডে মিল’ কর্মসূচি। মিড-ডে মিল কার্যক্রমের পণ্য সরবরাহ পেতে বিদ্যালয়ের জমিতে লাগানো হয় সবজী বাগান। ডিমের চাহিদা মেটাতে গড়ে তোলা হয় হাঁস মুরগীর খামার। আমিষের চাহিদা মেটাতে পুকুরে চাষ করা হয় মাছ। বাড়ি বাড়ি মুষ্ঠির চাল তুলে শুরু করা হয় মিড-ডে মিল। এ সময় ফকির বলেও অনেক শিক্ষককে তিরস্কার করে এলাকার কেউ কেউ। কিন্তু শিক্ষকরা কানকথায় কান না দিয়ে লক্ষ্য পূরণে কাজ করতে থাকেন।
ধীরে ধীরে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যায়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও পাশের হার শতভাগ। শিক্ষক-শিক্ষিকা সহ ছাত্রছাত্রীদের জন্য বাধ্যতামূলক স্কুলড্রেস চালু করা হয়।
আরও পড়ুন: ত্রিমুখী সংঘর্ষে নিহত ৩
২০১৩ সালে রেজিষ্টার্ড চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হয় এবং বরাদ্দ মিলে চারকক্ষ বিশিষ্ট এক শ্রেনীকক্ষের।ওই শ্রেনীকক্ষের ভেতরে ও বাইরে অংকন করা হয়েছে শিশুদের শিক্ষনীয় বর্ণ। শ্রেনীকক্ষের দেওয়ালে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে মনীষিদের বাণী ও ছবি। বঙ্গবন্ধু ও ৭ বীর শ্রেষ্ঠের ছবি, ফুল-ফল, পশু-পাখি বাঘ, হরিণ ইত্যাদি কোনটির কমতি নেই।
ডিজিটাল দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে আঁকা হয়েছে মোবাইল, টিভি, ল্যাপটপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদির মনোগ্রাম। বারান্দার পিলারে বসানো হয়েছে স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, এ থেকে জেড পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি বর্ন , সংখ্যা । এছাড়াও প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে জড়িত পেয়াজ মরিচ আদা, আলু,পটল, ইত্যাদির ছবি সহ বাংলা ও ইংরেজি নাম। এ জন্য স্লিপ বরাদ্দের জন্য অপেক্ষা না করে নিজেদের অর্থে সজ্জিতকরণ করা হয়েছে বিদ্যালয়টি।
এ ব্যপারে প্রধান শিক্ষক এরফান আলী বলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ মনোরম করে গড়ে তুলতে শিক্ষকরা সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছেন। বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ কালে ৪ জন শিক্ষক বকেয়া বেতন হিসেবে যে ৩৬ লক্ষ টাকা পেয়েছিলাম তা দিয়ে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণ করি। শুধু শিল্পীদের মজুরীতে ব্যয় হয়েছে ৫২ হাজার টাকা।
কোন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার না থাকলেও এ বিদ্যালয়ে রয়েছে শহীদ মিনার। নিজেদের অর্থে নির্মাণ করা হয়েছে এটি। জমির সীমানায় বসানো হয়েছে হাফ প্রাচীর। প্রাচীরের গায়ে অংকন করা ছবি, কবিতা, ছড়াসহ নানা ধরনের শিক্ষনীয় বিষয়। শিশু-শিক্ষার্থীদের খেলার উপকরণের পাশাপশি বিদ্যলয়ের শিক্ষার পরিবেশ আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে শিশু পার্কের আদলে বসানো হয়েছে হাতি, জিরা, পুকুরে করা হয়েছে নৌ বিহারের ব্যবস্থা। বিদ্যালয়টি ঘুরে দেখার প্রয়োজনে নির্মাণ করা হয়েছে পুকুরের চারপাশে পায়ে হাঁটা রাস্তা ও বিশ্রামাগার।নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। এজন্য ব্যয় হয়েছে ৩৮ লক্ষ টাকা।
প্রধান শিক্ষক এরফান আলী বলেন, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিবারই বৃত্তি পেয়েছে, পাশের হার শতভাগ, গড়ে তোলা হয়েছে মনোরম পরিবেশ। রয়েছে মিড-ডে মিল। আমাদের মিড ডে মিল কর্মসূচি দেখে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয় সারাদেশে মিড-ডে মিল চালুর প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেই থেকে জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখার অনুপ্রেরণা থেকে কাজ করি এবং শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা দখল করি।
সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো: মন্জুরুল ইসলাম বলেন, প্রধান শিক্ষক এই বিদ্যালয়টিকে আনন্দময় করতে শিশুদের চাহিদা ও পছন্দের বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে বিদ্যালয়টিকে সজ্জিত করেছেন। শিক্ষার্থীদের কাছে ভয়ের না হয়ে বিনোদন উপযোগী করে গড়ে তুলেছেন।
জেলা প্রশাসক মাহবুবুর রহমান বলেন, চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আমাদের গর্ব।এ বিদ্যালয়টি এ বছর দেশসেরা নির্বাচিত হয়েছে। ১২ মার্চ ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ ২০২৩ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রধান শিক্ষককে পুরস্কৃত করা হবে।
সান নিউজ/এনকে