নিজস্ব প্রতিবেদক:
আদাবর বাজারের একদম কাছেই বাসাটি। নিচতলায় পাশাপাশি কয়েকটি ঘরের বন্ধ দরজার ওপর শ্রেণির নাম লেখা। দেয়ালে ফুল-লতা-পাতা আঁকা। এসব আয়োজন নিয়ে করোনার সময়ে সুনসান পড়ে আছে ছোট্ট কিন্ডারগার্টেন পপুলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।
একটু ভালো ভাবে তাকাতেই ঘরের দরজা একটু ফাঁক দেখা গেল, ভেতরটা অন্ধকার। মুঠোফোনে কল দিলে পাশের ক্লাসঘর থেকে বেরিয়ে এলেন প্রধান শিক্ষক আমিনা বেগম। আপাতত স্কুলের দুটি ঘরে তার এলোমেলো সংসার।
নিজেই অফিস ঘর খুলে এই প্রতিবেদককে বসতে দিলেন আমিনা। বললেন, প্রায় চার মাস হলো স্কুল বন্ধ, ছেলেমেয়েদের বেতন আদায়ও বন্ধ। দোতলায় থাকতেন, খরচ কমানোর জন্য বাসা ছেড়ে দিয়ে স্বামী আর দুই মেয়েসহ স্কুলে উঠেছেন।
গত মার্চ থেকে স্কুলের ভাড়াও বাকি পড়েছে। দুজন কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে আমিনা এখন রাস্তার ধারে শামিয়ানা খাটিয়ে টেবিল পেতে ফল বিক্রি করছেন। কাছেই সম্পা মার্কেটের কাছে অস্থায়ী এই দোকানের ব্যানারে লেখা, ‘১০০% ফরমালিনমুক্ত রাজশাহীর বিখ্যাত আম ও লিচুর মেলা’।
সেদিন ৪ জুলাই সকালে দোকান দেখাতে নিয়ে গিয়ে আমিনা বলেছিলেন, ‘আম তো কিছুদিন পর শেষ হয়ে যাবে। তখন কী করব? কারও কাছে হাতও পাততে পারব না।’
আমিনার স্কুলটি নিম্নবিত্ত এলাকায়। শিক্ষার্থীদের বেতন কম। কিন্তু এখন সেটুকুও অভিভাবকেরা দিতে পারছেন না। উজান আহমেদ এই স্কুলের ২৩৫ জন শিক্ষার্থীর একজন। তার গাড়িচালক বাবার বেতন করোনাকালে অর্ধেক হয়ে গেছে।
স্কুলে শিক্ষক আছেন ১২ জন। তাঁরা বেতনের সঙ্গে টিউশনির আয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলতেন। এখন সবই বন্ধ। অনেকে ঢাকা ছেড়েছেন। আবদুল্লাহ আল মামুন যেমন কুষ্টিয়ায় গ্রামের বাড়িতে ফিরে টুকটাক চাষবাস করে চলতে চেষ্টা করছেন। মুঠোফোনে তিনি বললেন, সুদিনের আশা মিলিয়ে যাচ্ছে।
এলাকা ঘুরে করোনাদুর্গত বেশ কয়েকটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল দেখা গেল। আরেকটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকও পরিবার নিয়ে স্কুলের দুটি ঘরে উঠেছেন। একটি স্কুল বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে, দরদাম চলছে।
দেশজুড়ে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা এসব ছোটখাটো কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রায় সবই ভাড়াবাড়িতে চলে। আমিনার মতো অনেক উদ্যোক্তা নিজেরাই প্রধান শিক্ষক। শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনসহ সব খরচ ওঠে শিক্ষার্থীদের বেতন থেকে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে করোনা ছুটি শুরু হয়েছে গত ১৭ মার্চ থেকে। সেই ইস্তক শিক্ষার্থীদের বেতনপত্র আদায় বন্ধ। উদ্যোক্তারা বলছেন, স্কুল খুললেও অনেক ছেলেমেয়ে হয়তো ফিরবে না। বাড়িওয়ালারা ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। অনেক উদ্যোক্তা গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন বা যাচ্ছেন। শিক্ষকেরাও চলে যাচ্ছেন, পেশা বদলাচ্ছেন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেছেন, হবিগঞ্জের একজন শিক্ষক চা-কফি বিক্রি করছেন। দিনাজপুরের একজন শিক্ষক রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করছেন। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের একজন শিক্ষক নৌকা চালাচ্ছেন।
বাংলা ও ইংরেজি দুই মাধ্যমেই কিন্ডারগার্টেন হচ্ছে শিশুদের হাতেখড়ির বিদ্যায়তন। তবে স্কুলগুলো সচরাচর পঞ্চম শ্রেণি পার করিয়ে দেয়। গত বছর আমিনার স্কুল থেকে ৩১ জন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছে। কিছু স্কুল আবার দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়িয়ে অন্য স্কুলের নামে মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষা দেওয়ায়।
দেশে এমন স্কুলের সংখ্যা কত, সরকারের কাছে তার হিসাব নেই। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসাবে সরকারি স্কুল, কিন্ডারগার্টেন ও এনজিওর স্কুলসহ প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা সোয়া লাখের কিছু বেশি। সব মিলিয়ে পড়ে প্রায় পৌনে দুই কোটি ছেলেমেয়ে।
কিন্ডারগার্টেনগুলোর দু-তিনটি সমিতি আছে। সেগুলোর হিসাবে, দেশে এমন স্কুলের সংখ্যা ৪০ হাজারের কিছু বেশি। একেক স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০০ থেকে ৪০০ পর্যন্ত হতে পারে। মোট শিক্ষার্থী ৫০ লাখের বেশি। আর শিক্ষক আছেন প্রায় ৬ লাখ।
সান নিউজ/ আরএইচ