মানতাশা (ছদ্মনাম) দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭ তম আবর্তনের একজন নারী শিক্ষার্থী। সম্প্রতি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী অভিযোগ সেল’ একটি লিখিত অভিযোগ করেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তার এক ছেলে সহপাঠী তাকে প্রায় সময় ইনবক্সে বিভিন্ন মেসেজের মাধ্যমে বিরক্ত করে, রেসপন্স না করায় একসময় পর্ণ ভিডিও পাঠায়। এমনকি মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে সেখানে তাকে এড দিয়ে বিব্রতকর টেক্সট দিতে থাকে। এতে বাধ্য হয়ে তাকে ব্লক করে দেয় এবং প্রশাসন এর কাছে অভিযোগ দেয়।
আরও পড়ুন : ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান
বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একজন ৪৬তম আবর্তনের শিক্ষার্থী নয়নতারা (ছদ্মনাম) লিখিত অভিযোগ করেন যে, তার ফেইসবুক একাউন্ট থেকে ছবি সংগ্রহ করে একটি ফেইক একাউন্ট খুলে পরিচিত বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন অশ্লীল বার্তা এবং ইডিটেড ছবি পাঠায়। এতে সে সম্মানহানির সাথে বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ জন নারী শিক্ষার্থীর উপর অনলাইনে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয় । যেখানে নারী শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে শতভাগ নিরাপদ থাকা সত্ত্বেও প্রতিনিয়তই তারা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে যার মধ্যে অনলাইনের ৭৭% নারী শিক্ষার্থী ফেসবুক-মেসেঞ্জারে, ১২% হোয়াটসঅ্যাপে, ৮% ইনস্টাগ্রামে, ৩% টুইটারে এবং একাধিক মাধ্যমে প্রায় ৪৫% নারী শিক্ষার্থীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এক্ষেত্রে ইনবক্সে বিব্রতকর ছবি বা ভিডিও পাঠানোর হার ১২.৫%, মিথ্যা বা ভুয়া একাউন্ট খুলে অন্যের কাছে বার্তা পাঠানোর হার ৩৯.৩%, পোশাক নিয়ে বাজে মন্তব্য বা বার্তার হার ১৮.৮%, হুমকিমূলক বার্তা বা ছবি বা ভিডিও ৮.৭%, চলাফেরা বা সৌন্দর্যতা নিয়ে বাজে বার্তা ৬.৯% ও অন্যান্য ১৩.৮%।
জরিপে কাদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয় সেই প্রশ্নে প্রায় ৪২% শিক্ষার্থী সহপাঠীর দ্বারা, ৩৬.৭% সিনিয়রদের দ্বারা, ৮.২% জুনিয়রদের দ্বারা এবং অন্যান্য হিসেবে একাধিক ব্যক্তির দ্বারা ২.২%, এছাড়াও আশ্চর্যের বিষয় হিসেবে এখানে উঠে এসেছে নারী বন্ধু,শিক্ষক, কর্মচারী দ্বারাও প্রায় ৯.৬% নারী শিক্ষার্থী অনলাইনে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
আরও পড়ুন : আইসিটি অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের পর্দা উঠেছে
এ ব্যাপারে তারা কোন পদক্ষেপ বা অভিযোগ দায়ের করেছে কিনা জানতে চাইলে প্রায় ৯০% শিক্ষার্থী অভিযোগ না দেয়ার কথা এবং প্রায় ৬০% শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের নারীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সেলের ব্যাপারে অবগত নয় বলে জানান।
এছাড়াও অভিযোগ না দেয়ার কারণ হিসেবে মানসিক চাপ,বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক সম্মানহানি, বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতা, পারিবারিক সমস্যা, সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে অজ্ঞতা ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী অভিযোগ সেল’ এ একটি অভিযোগ জমা হওয়ার পরে নিয়ম হলো ৬০ দিনের মাঝেই নিষ্পত্তি করা অপরাধীর শাস্তি দেওয়া কিন্তু অধিকাংশ গুলোতেই দীর্ঘ সময় ব্যয় করছে প্রশাসন।
আরও পড়ুন : অধিনায়ক বদলেও বদলায়নি ভাগ্য
এব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলের সভাপতি ড. জেবউননেছা বলেন, গত ৭ মাসে ৭টি অভিযোগ এসেছে। অভিযোগ আসার সাথে সাথেই তদন্ত করে অতিদ্রুত মাননীয় ভিসির অনুমতি নিয়ে মিটিং করে আমি সুপারিশ করি সিন্ডিকেট এর কাছে। পরবর্তীতে সিন্ডিকেট সভা থেকে পুরো নিষ্পত্তি হয়ে থাকে।
একটা অভিযোগ জমা হওয়ার পরে নিয়ম হলো ৬০ দিনের মাঝেই নিষ্পত্তি করা কিন্তু অধিকাংশ গুলোতেই দীর্ঘ সময় লাগানো হয়। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, অভিযোগ নিয়ে তদন্ত ও যাচাই বাছাইয়ের ফলে হয়তো অনেক সময় একটু সময় বেশী লেগে যায়। তবে আমার সেলে কোন অভিযোগ পরে থাকে না।
এত কম অভিযোগ আসার কারন হিসেবে তিনি বলেন, আমাদের সমাজটাই এমন হয়েছে প্রতিবাদ করলে অনেকেই জানবে, সমাজ কিভাবে দেখবে, ফ্রেন্ড সার্কেল কিভাবে নিবে, বিবাহের একটা ব্যাপার থাকে। আমরা যতটাই আধুনিক হইনা কেন নিজের উপর ঘটে যাওয়া অপরাধ গুলো প্রকাশ করি না বা করতে চাই না। আজ কাল কিছু একটা হলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়, এটা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা হয় এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অনেকে আসে না প্রতিবাদ করার জন্য। এছাড়াও অনেকেই অভিযোগ দিতে ইচ্ছুক হলেও পরবর্তীতে পরিবারের চাপে অভিযোগ দিতে চায়না।
এছাড়াও ক্যাম্পাসের প্রতিটি শিক্ষার্থী যেনো এই সেল এর ব্যাপারে জানতে পারে সেটির প্রচারণা হিসেবে শিক্ষার্থীদের জানানোর জন্যে প্রতিটি বিভাগের শিক্ষার্থী কল্যাণ উপদেষ্টাদের সাথে যোগাযোগ করা হয় বলে তিনি জানান।
আরও পড়ুন : সারাদেশে বজ্রপাতে ৬ কৃষকসহ নিহত ৮
এছাড়াও ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী অভিযোগ সেল’ সভাপতির বাহির একজন একজন সচেতন নারী হিসেবে ড. জেবাউননেছা বলেন,সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় হওয়ার কারনেই এমন অপরাধ হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালে মহামান্য হাইকোর্টের নিদের্শনার আলোকে দেশের প্রথম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েই ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী অভিযোগ সেল’ গঠিত হয়। এবছরের গত ০২ জানুয়ারি এই যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলের নতুন সভাপতি হিসেবে মনোনীত হয়েছেন লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. জেবউননেছা।
প্রো-ভিসি(প্রশাসন) অধ্যাপক শেখ মো. মনজুরুল হক অনলাইনে যৌন হয়রানির প্রতিকার এর জন্যে প্রশাসনের পদক্ষেপ সম্পর্কে বলেন, শিক্ষার্থীদের অনলাইনে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সবাইকে সতর্কতার সাথে অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করতে হবে। কেননা সবাইকে তো হাতে ধরে ধরে এই বিষয়গুলো বুঝানো সম্ভব না, তবে কেউ এরকম সম্মুখীন হলে সচেতন শিক্ষার্থী হিসেবে অভিযোগ জানালে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব এবং ফলে হয়রানির পরিমাণও কমানো যাবে। এছাড়াও অভিযোগ আসার পর, যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল আর সিন্ডিকেট সভায় যা সিদ্ধান্ত দেয় সেটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। এখানে প্রশাসন কোন হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
প্রতিবেদক : তামীমদারী
ডিজাইন : তামীমদারী
শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সান নিউজ/এইচএন