নিজস্ব প্রতিবেদক: তৃতীয়বারের মতো শিক্ষা আইনের খসড়া ফেরত পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে খসড়াটি চূড়ান্ত করে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য গত সপ্তাহে পাঠানো হয়েছিলো। বিভাগের সংশ্লিষ্ট কমিটি বুধবার (১৩ অক্টোবর) প্রস্তাবিত খসড়াটি পর্যালোচনায় বসে। কিন্তু নানান ধরনের ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা, অস্পষ্টতা ও ঢাউস আকারের কারণে বেশকিছু পর্যবেক্ষণসহ সেটি ফেরত পাঠানো হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ওই সভায় যোগ দেন অতিরিক্ত সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) খালেদা আক্তার। তিনি বলেন, আইনের খসড়া নিয়ে ওনারা (মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ) আলোচনা করেছেন। যখন খসড়াটি আমাদের দেবেন, তখন বুঝতে পারব কেন তারা ফেরত পাঠালেন।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে একটি আইন করতে এত দীর্ঘসময় লাগার উদাহরণ নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা জানান, একটি আইন বারবার সংশ্লিষ্ট কমিটিতে উপেক্ষিত হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। পাশাপাশি কার বা কাদের অদক্ষতা বা অক্ষমতার কারণে উপযুক্ত খসড়া তৈরি হচ্ছে না- সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। এটাকে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা বলেও মনে করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, নিশ্চয়ই যুক্তিসঙ্গত কারণেই সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে এটি ফেরত যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ আমলে নিয়ে খসড়া তৈরি করা হলে ফেরত যাওয়ার কথা নয়। এভাবে বারবার ফেরত পাঠানোর মতো ঘটনার উপক্রম হওয়া সত্যিই বেদনাদায়ক (রিয়ালি শকিং)। খসড়া তৈরিকালে দক্ষ ব্যক্তিদের পরামর্শ নেওয়া হলে এমন ঘটার কথা নয়।
২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১১ সাল থেকেই এই শিক্ষা আইন তৈরির কাজ চলছে। মূলত এই আইনের বিভিন্ন দিক প্রথম থেকেই ব্যাপক আলোচনায় এসেছিল। এর মধ্যে আছে কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউশন, নোট-গাইড ও সহায়ক পাঠ্য। আরও আছে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও বিদেশি শিক্ষাক্রমের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ইত্যাদি।
এসব বিষয় নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষক ও পুস্তক সংগঠন আন্দোলনে নেমেছিলো। ফলে প্রথমে শাস্তির বিধানসহ একটি খসড়া প্রস্তাব করা হলেও ২০১৩ সালে খসড়া থেকে তা তুলে নিয়ে একটি ‘দুর্বল’ খসড়া তৈরি করা হয়েছিলো। সবমিলে খসড়া তৈরিতে লেগে যায় প্রায় ৫ বছর। ফলে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রথমে শিক্ষা আইনের যে খসড়া করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছিলো, তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফেরত আসে।
এভাবে পরে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয়বার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। কিন্তু পরের বছর তা ১২টি পর্যবেক্ষণসহ ফেরত আসে। মন্ত্রিসভার পর্যবেক্ষণ নিয়ে এতদিন কাজ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এজন্য সাবেক সচিব হাবিউল আওয়ালকে পরামর্শকও নিয়োগ দেওয়া হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওই সভা সূত্রে জানা গেছে, প্রস্তাবিত আইনের খসড়ার অনেক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। আইনের আকার ছোট করতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আইন হলো নীতিনির্ধারণী নির্দেশনা। এখানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে খুঁটিনাটি থাকার প্রয়োজন নেই। আইনের নির্দেশনার আলোকে বিধিমালায় সুস্পস্ট করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে বৈঠকে অংশ নেওয়া এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রিসভা বৈঠকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার আইনের কলেবর ছোট করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আইন অহেতু বড় হলে কার্যক্ষেত্রে সমস্যা হয়। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে শিক্ষা আইনের কলেবরও ছোট করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
সূত্র আরও জানায়, দেশের সব আইনের উৎস সংবিধান। কিন্তু শিক্ষা আইন প্রণয়নে যৌক্তিকতায় সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদের কোনো রেফারেন্স উল্লেখ হয়নি। সংবিধানে শিক্ষার বিষয়ে ১৭ অনুচ্ছেদে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া আছে। সেই সঙ্গে যে শিক্ষানীতির আলোকে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা চলছে তার কথাও উল্লেখ নেই।
২০১০ সালে বাংলাদেশের সর্বশেষ শিক্ষানীতি প্রণয়ন হয়েছে। সূত্র জানায়, একই সঙ্গে আইনে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষাবিষয়ক যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সেটারও রেফারেন্স যুক্ত করতে বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ৩.১৮ ধারায় শিক্ষা নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত আইনের চতুর্থ অধ্যায়ে থাকা মাধ্যমিক শিক্ষার বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে নতুন করে চিন্তা করা হচ্ছে। কিন্তু খসড়ায় বিদ্যমান পদ্ধতির কথাই বলা হয়েছে। সূত্র জানায়, যেহেতু এই স্তরটি নিয়ে নতুন করে চিন্তা করা হচ্ছে তাই এখানে আপডেট করা যেতে পারে। যদি কোনো অংশ পরবর্তী সময়ে কার্যকর করার প্রয়োজন হয় তাহলে সেটার ভূতাপেক্ষ প্রয়োগের ব্যবস্থা রাখা যাবে।
খসড়া আইনের পঞ্চম অধ্যায়ে শুধু কওমি মাদ্রাসার কার্যক্রম ও মানোন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়টি আলাদাভাবে দেওয়ার পরিবর্তে মাদ্রাসা শিক্ষার সামগ্রিক অংশে উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
খসড়া আইনের ২২ ধারায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদির বিষয় সংক্রান্ত বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে এটা সংক্ষিপ্ত করে বিস্তারিত বিধির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে বলা হয়।
অষ্টম অধ্যায়ে সংস্কৃতি ও পালি শিক্ষা বিদ্যমান আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। বৈঠকে এ বিষয়টি শুধু দুটি ভাষার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে প্রথমেই বাংলা ভাষার কথা উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। এরপর বিদেশি ভাষা হিসেবে সংস্কৃতি, পালি, আরবি, ফার্সিসহ প্রয়োজনীয় ভাষার কথা উল্লেখ করতে বলা হয়েছে।
সর্বশেষ খসড়ার উল্লেখযোগ্য বিষয় : প্রস্তাবিত আইনে শিক্ষকদের শাস্তির ব্যাপারে মোটামুটি নমনীয়তা দেখানো হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাটের ঘটনায় সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসছে পরিচালনা কমিটির ব্যাপারে। এ বিষয়ে কোনো বর্ণনা নেই। যথারীতি বাণিজ্যিক কোচিংকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। তবে শিক্ষকরা কোচিং সেন্টার করলেও সেখানে নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে পারবেন না।
এমনকি যে শিক্ষার্থীর ক্লাস থাকবে, সেই সময়ে কোচিং সেন্টারে তাকে পড়ানো যাবে না। কোনো নামেই নোট-গাইড চলবে না। আইনের ভাষ্য অনুযায়ী, পাঠ্যবইয়ের পাঠের আলোকে পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক বই প্রকাশ করা যাবে না। বর্তমানে বাংলাবাজারকেন্দ্রিক যে পুস্তক ব্যবসা আছে, তাদের বাণিজ্যের মূল অংশই এটি। তবে সরকারি অনুমতি সাপেক্ষে সহায়ক পুস্তক প্রকাশ করা যাবে। পাঠ্যবইয়ের আলোকে পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলি পত্রিকায় বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশের জন্য সরকারি অনুমতি নিতে হবে।
জানা গেছে, প্রস্তাবিত ১৮ পৃষ্ঠার খসড়ায় মোট ৫৭টি ধারা যুক্ত করা হয়েছে। ২০১৩ সালের প্রথম খসড়ায় ৬৭টি ধারা ছিল। আইনে পাঁচ স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে-প্রথম শ্রেণির আগে প্রাক-প্রাথমিক, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি উচ্চ মাধ্যমিক এবং এরপর উচ্চশিক্ষা স্তর।
২০১০ সালে সংসদে পাশ করা শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক বাদে তিন স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা আছে। ড. কুদরত-এ-খুদা কমিশনের প্রতিবেদনেও অনুরূপ সুপারিশ ছিলো। তবে শিক্ষা আইনের প্রস্তাবটি সম্প্রতি অনুমোদিত জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখার (এনসিএফ) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সান নিউজ/এফএআর