স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট : ১৯১১ সালে ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গভঙ্গ রদের পর পূর্ববঙ্গের মানুষদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ প্রশমিত করতে ব্রিটিশ সরকার ঘোষণা দেয় পূর্ববঙ্গের তৎকালীন রাজধানী ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি মহল বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করলেও নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯২১ সালের এ দিনে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। একেবারে শূণ্য থেকে শুরু করে জাতি বিনির্মানের ভূমিকা রাখে পূর্ববঙ্গের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক বিশ্ববিদ্যালয়টি। শুধু জাতি গঠনই নয়, গণতন্ত্রের জন্য আপোসহীন সংগ্রামেও নেতৃত্ব দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিষ্ঠার ইতিহাস : ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার পর পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের বিরোধীতার মুখে ৬ বছর পরে ১৯১১ সালে রদ করা হয় বঙ্গভঙ্গ। বঙ্গভঙ্গ রদের ঘটনায় পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগণ ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ ও আশাহত হন। ঢাকার তৎকালীন নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে একদল মুসলিম জনপ্রতিনিধি বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান সর্বপ্রথম ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি। সেই সময় কলকাতার তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত ও হিন্দু নেতারা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা রোধে বিরোধীতা করেন। তারা শুধুমাত্র স্মারকলিপি প্রদান করেই ক্ষান্ত থাকেননি, তারা প্রতিবাদ সভা থেকে শুরু করে র্যালি পর্যন্ত আয়োজন করেছিলেন।
১৯২১ সালের জুলাই মাসে ৩টি অনুষদের অধীনে (বিজ্ঞান, কলা ও আইন) ১২টি বিভাগ ও ৮৪৭ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির।
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন : প্রতিষ্ঠার পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়। এ আন্দোলনের দার্শনিক নেতা ছিলেন মনীষী কাজী আবদুল ওদুদ এবং আবুল হুসেন। সামাজিক পশ্চাৎপদতার সাথে যখন পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় কেন্দ্রীয় সরকারের উসকানীতে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াশীলতায় সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক শাসনের জন্ম হয়েছিলো তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকগণ বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাদের প্রচেষ্টায় পরবর্তীকালে গড়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক চেতনা।
ভাষা আন্দোলন : পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরপরই যখন পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক পথ রুদ্ধ করতে ভাষার টুটি চেপে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছিলো তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক এ অপচেষ্টার বিরোধীতা করেন। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রীয় ভাষা উর্দূ হবে জানালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখনই প্রতিবাদ জানিয়ে ‘না’ ‘না’ শব্দে জবাব দিতে থাকে। পরবর্তীকালে ভাষার পক্ষে জনমত গঠন, ভাষা আন্দোলনের সূচনা, ভাষার প্রশ্নে আপোসহীন ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক। প্রতিবাদে ঢাকায় ছাত্র -বুদ্ধিজীবিরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছিলেন। গঠিত হয়েছিলো তমদুধন মজলিস। যারা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে নানারকম সভাসমিতি ও আলোচনার আয়োজন করে।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান : পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো প্রথম থেকেই সোচ্চার। অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নির্মাণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সর্বজনবিদিত।
পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পর ভাষার প্রশ্নে প্রথম প্রতিবাদ করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আমতলায় জড়ো হয় ছাত্র-ছাত্রীরা। এরপর ছয় দফা প্রশ্নে জনমত গঠন, ৬৯ এর গণ-অভ্যূত্থানে ভূমিকা রেখেছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এসব কারণেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনির নজর ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে ঘিরে। ২৫ শে মার্চের কালরাত্রিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকাগুলোতে নেমে আসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনির নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনা।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লেখা হয়, ‘মধ্যরাতে ধুম্রকুন্ডলী এবং অগ্নিশিখা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছাড়িয়ে আকাশে মাথা তুললো।’ সেদিন রাতে নিহত ১৯ জন শিক্ষক, ১০১ জন ছাত্র, ১ জন কর্মকর্তা ও ২৮ জন কর্মচারী শহীদ হয়। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো।
নারী শিক্ষায় : বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকে এ অঞ্চলের নারীদের শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা তেমন ছিল না। তৎকালীন উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান কলকাতার সাথে দূরত্ব, শিক্ষার অভাব এবং রক্ষণশীলতার বাঁধা পেরিয়ে মুসলমান পরিবারের মেয়েরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাবে, এমন ভাবনা ভাবত না অধিকাংশ পরিবার।
সে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এ অঞ্চলের মানুষের মনে রক্ষণশীল ও পশ্চাৎপদ সামাজিক অবস্থা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন তৈরি করেছিল।
শতবর্ষ আগে বিশ্ববিদ্যালয় যখন গঠন হয় তখন ৮৪৬ ছাত্রের সাথে ছাত্রী ছিলো মাত্র একজন। তাঁর নাম লীলা নাগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেন তিনি। শুরুর দিককার এসব ছাত্রীরা সমাজে একেকজন নারীশিক্ষার রোল-মডেল হিসেবে কাজ করেছেন। তাদের দেখে আরো মানুষ উৎসাহিত হয়েছেন, তারা নিজেরাও সমাজে নারীশিক্ষা বিস্তারে কাজ করেছেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা’ বইয়ে লিখেছেন, শুরুতে মুসলিম পরিবারের মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে খুবই কম পড়তে আসতেন। শুধু মুসলমান পরিবারই নয়, অনেক হিন্দু শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন না।
শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান কমেছে অনেক : শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে অবদান রেখেছিলো। একই সাথে অবদান রেখেছিলো শিক্ষা ও গবেষণায়। তবে গত তিন দশকে এ অবদানের হার অনেকটা কমেছে। শিক্ষা ও গবেষণায় দেশ সেরা হলেও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট সংকট, গবেষণায় শিক্ষকদের আগ্রহ কম থাকা, শিক্ষকদের রাজনৈতিক সম্পর্ক, ব্যক্তিস্বার্থ, অনিয়ম এবং ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতিতে দলীয় রাজনীতির প্রভাব বেড়ে যাওয়ার কারণে এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির। এ ধরনের পরিস্থিতি বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা বা শিক্ষা কার্যক্রমকে হুমকির মুখে ফেলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা এলেই দাপট দেখা যায় রাজনীতিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকার। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন বা অভিযোগের পাল্লা দিন দিন অনেক ভারি হচ্ছে।
লেখক ও গবেষক অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের মতে, ব্রিটিশ এবং পরে পাকিস্তান আমলে এই অঞ্চলের মানুষ যে পিছিয়ে ছিল, সেই অসামঞ্জস্য দূর করার ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসনের শেষদিকে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ২৭ বছর পর এদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। তখন এই অঞ্চল পাশ্চাৎপদ ছিল। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে। ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রাম, যেটা পরে ঢাকায় পাকিস্তান-বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হলো। তারপর ২৫ বছরের আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে পরিণত হলো। এই ঐতিহাসিক পরিস্থিতির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে ভূমিকা রেখেছে, সেটা হলো, একদল উচ্চশিক্ষিত মানুষ তৈরি করেছে। তারা ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে ভূমিকা রেখেছেন। পশ্চাৎপদ মুসলমানরা বৈষম্যের শিকার হতে থাকে। সেই প্রেক্ষাপটেই জাতীয় সব আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ ছিল সম্প্রদায় হিসাবে মুসলমান প্রধান। কিন্তু মুসলমানরা ছিল পশ্চাৎপদ শ্রেণি। এখানে অসামঞ্জস্য ছিল। সেটা দূর করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে।
সান নিউজ/এসএম