নিজস্ব প্রতিবেদক : উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির বই পৃষ্ঠা ও দাম বাড়িয়ে বাজারে বিক্রির ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। বই ছাপার অনুমতিপ্রাপ্ত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদন বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে শোকজ করা হয়েছে। সাত কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দিতে হবে। জবাব পাওয়ার পর পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির যেসব বই বাজারজাত করতে বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ও দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে এনসিটিবি। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রেই আইন অমান্য করেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এনসিটিবির আইন অনুযায়ী এই কাজ শাস্তিমূলক অপরাধ।
এদিকে, এনসিটিবির এই পদক্ষেপকে পক্ষপাতদুষ্ট ও বিতর্কিত বলে উল্লেখ করেছেন প্রকাশনা সংশ্লিষ্টরা। ৩৫টি বিষয়ের প্রতিটি একাধিক প্রতিষ্ঠানকে ছাপিয়ে বাজারজাত করতে অনুমোদন দেয়া হয়। এতে প্রতিষ্ঠান সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০টি। তবে কোনো কোনো বই একাধিক প্রতিষ্ঠান বাজারজাতের কাজ পেয়েছে। যেমন, আইসিটি বইটি বাজারজাত করছে ৫টি প্রতিষ্ঠান। সেই হিসাবে শতাধিক প্রতিষ্ঠান এই স্তরের বই বাজারজাত করছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই বইয়ের পৃষ্ঠা ও দাম বাড়িয়ে নিয়েছে। কিন্তু এনসিটিবি শোকজ করেছে মাত্র ৭টি প্রতিষ্ঠানকে। বাকিগুলোকে রহস্যজনক কারণে ছাড় দেয়া হচ্ছে।
তাতে ১৫টি বইয়ের ওপর চালানো অনুসন্ধানের তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দেখা গেছে, এনসিটিবি অনুমোদিত আইসিটি বইয়ে গড়ে পৃষ্ঠাসংখ্যা ২২০-২৪২। আর ১৪ আগস্ট বাজারে পাওয়া বইগুলোর পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫০০-৬৮০। পদার্থ বিজ্ঞানের প্রথম পত্রে এনসিটিবির অনুমোদিত বইয়ে পৃষ্ঠা ৩৩০-৩৬৩।
বাজারে পাওয়া বইয়ে পৃষ্ঠা ৬০০-৮০০। পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রে ৩৩০-৩৬৩ পৃষ্ঠার বদলে বাজারে ৬০০-৮৫০ পৃষ্ঠার বই পাওয়া গেছে। এভাবে বাজারে আরও আছে, রসায়ন প্রথম পত্রে ২৫০-২৭৫ পৃষ্ঠার স্থলে ৫০০-৭০০; দ্বিতীয় পত্রে ২৫০-২৭৫-এর স্থলে ৬০০-৮০০ পৃষ্ঠা; জীববিজ্ঞান প্রথম পত্রে ২৩০-২৪০-এর স্থলে ৪৫০-৫০০; দ্বিতীয় পত্রে ২৩০-২৪০-এর স্থলে ৪০০-৪৫০; হিসাববিজ্ঞান প্রথম পত্রে ৩০০-৩৩০ পৃষ্ঠার বদলে ১০০০-১৩০০; দ্বিতীয় পত্রে ৩০০-৩৩০-এর স্থলে ১০০০-১৪০০; উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও বিপণন প্রথম পত্রে ২২০-২৪০-এর স্থলে ৬০০-৭২৫; দ্বিতীয় পত্রে ২০০-২২০-এর স্থলে ৬০০-৭২৫; অর্থনীতি প্রথম পত্রে ২৩০-২৪০-এর স্থলে ৪৫০-৬০০; দ্বিতীয়পত্রে ২৩০-২৪০-এর স্থলে ৪০০-৪৫০; ভূগোল প্রথম পত্রে ২৫০-২৭৫-এর স্থলে ৩০০-৪০০ আর দ্বিতীয় পত্রে ২৫০-২৭৫-এর স্থলে ৩০০-৪০০ পৃষ্ঠার বই।
এসব বইয়ের প্রতিষ্ঠানকেও শোকজ করা হলে সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত ১৫টি। এনসিটিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে কয়েকজন কর্মকর্তার সিন্ডিকেট আছে। তাদের অপছন্দের প্রতিষ্ঠান দেখেই শোকজ করা হয়েছে। অথচ সঠিকভাবে তদন্ত করে দায়ী প্রতিষ্ঠানকে শোকজ করলে শিক্ষার্থী ও সরকার উভয়ই লাভবান হতো। এতে পৃষ্ঠা ও দাম বাড়ায় শিক্ষার্থীদের লাখ লাখ টাকা বাড়তি খরচ হচ্ছে। অপরদিকে বাড়তি টাকার ওপর সরকার রাজস্বও পাচ্ছে না। যদি বাড়তি দামসহ বইয়ের অনুমোদন নেয়া হতো, তাহলে এনসিটিবি বাড়তি রাজস্ব পেত।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেছেন, পক্ষপাতমূলক আচরণের কোনো কারণ নেই। শোকজ দেয়ার মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার কাজটি চলমান থাকবে। যেসব প্রতিষ্ঠানকে বইয়ের কাজ দেয়া হয়েছে, তাদের প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে ৪ নভেম্বরের মধ্যে অনুমোদিত বইয়ের কপি জমা দিতে হবে।এবংবাজার থেকেও এনসিটিবি বই সংগ্রহ করবে।
বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহসভাপতি প্রকাশক শ্যামল পাল বলেন, বই জমা দেয়ার আগে কীসের ভিত্তিতে শোকজ আমাদের বোধগম্য নয়। এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, নিশ্চিত হয়েই সংশ্লিষ্টদের শোকজ করা হয়েছে। বাকিদের দেয়া কপি এবং বাজারে পাওয়া কপির ওপর পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেয়া হবে।
জানা গেছে, বই বাজারজাত করার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান প্রতারনার আশ্রয় নিয়েছে। বর্ধিত কলেবরে প্রকাশিত বই তারা বাজারজাত করছে। বিষয়টি প্রমাণ পাওয়া গেছে আইসিটি বিষয়ক বইয়ের ওপর সাম্প্রতিক বিতর্কের ঘটনায়। ভয়েজার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পৃষ্ঠা ও দাম বাড়ানোর ঘটনায় অনুমোদন বাতিল করা হয়। তখন প্রতিষ্ঠানটি দুই ধরনের বই এনসিটিবিতে দাখিল করে।
এ প্রসঙ্গে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে, এনসিটিবির অনুমোদিত বই সংশ্লিষ্ট প্রকাশকরা বাজারে দিয়েছেন এবং তা আছে। কিন্তু এনসিটিবি যে বই অনুমোদন দিয়েছে, সেগুলোর বাজারে চাহিদা কম। কেননা, সীমিত পরিসরে পাঠ ভালোভাবে বা বিস্তারিত বুঝিয়ে তৈরি নয়। এটা বুঝতে শিক্ষার্থীদের সমস্যা হয়।
এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, সরকারিভাবে নির্ধারিত কারিকুলামের ওপর বেসরকারিভাবে রচিত বই অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এনসিটিবির বিশেষজ্ঞ কমিটি এটি করেছে। টেক্সটবই যে আকারের হওয়া দরকার সেটাই করা হয়েছে। মানহীন ও চাহিদাপূরণ করবে নাএমন বই অনুমোদন দেয়া হয়নি।
সান নিউজ/এসএ