নিজস্ব প্রতিবেদক:
দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনার দায় পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন চতুর্থ শ্রেণির বরখাস্ত হওয়া কর্মচারী (মালি) রবিউল ইসলাম ফরাস (৪৩)।
কিন্তু এর আগে র্যাবের কাছে হামলার দায় স্বীকার করেন উপজেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত সদস্য আসাদুল ইসলাম (৩৫)। এ অবস্থায় প্রকৃত হামলাকারী কে, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পুলিশ বলছে, অল্প সময়ের মধ্যেই বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যাবে।
শনিবার (১২ সেপ্টেম্বর) দিনাজপুরের পুলিশ সুপার কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘রবিউল প্রাথমিকভাবে দায় স্বীকার করেছেন। তার তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বেশ কিছু আলামতও জব্দ করেছি। এ ছাড়া তার বক্তব্যের সঙ্গে সিসিটিভি ফুটেজের মিল পাওয়া গেছে। আমরা অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে রিমান্ডে নেবো।’
দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘হামলাকারীর সঙ্গে রবিউল ইসলামের শারীরিক গড়ন ও হাঁটা-চলার অনেক মিল রয়েছে। ক্ষোভ থেকেই রবিউল এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারেন। তবে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। নতুন তথ্য পেলে জানানো হবে।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘র্যাবের কাছে আসাদুল ইসলাম কিভাবে স্বীকারোক্তি দিলেন, আমি সে বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে তাদের স্বীকারোক্তি শেষ কথা নয়। আরো তদন্ত হলে বিস্তারিত জানা যাবে।’
এ মামলার প্রধান আসামি আসাদুল ইসলাম ও ইউএনওর বাসভবনের নৈশপ্রহরী নাদিম হোসেন পলাশকে শনিবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অন্য দুই আসামি রংমিস্ত্রি নবীরুল ইসলাম ও সান্টু কুমার বিশ্বাসকেও শুক্রবার (১১ সেপ্টেম্বর) আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। আর রবিউল ইসলামকে ছয়দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
সব মিলিয়ে পাঁচজনকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। যুবলীগ নেতাসহ স্থানীয় আরও কয়েকজন এবং উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মচারীসহ এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ জনকে আটক করে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
আসাদুল, নবীরুল ও সান্টু- এই তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর গত ০৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে রংপুরে ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে র্যাব সংবাদ সম্মেলন করে। র্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃত আসাদুল ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। আসাদুল র্যাবকে জানিয়েছেন, নিছক চুরির অভিপ্রায় থেকে ঘটনাটি ঘটে যায়। নবীরুল ওই চুরির ঘটনার মুল পরিকল্পনাকারী আর সান্টু সহযোগী ছিলেন বলেও দাবি করেন আসাদুল।
অথচ তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা এখন বলছেন, সাতদিন করে রিমান্ডে নিয়েও এই তিনজনের কারও কাছ থেকে ঘটনা নিয়ে উপসংহারে পৌঁছানো যায়, এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তারা এখন মালি রবিউল ও গ্রেপ্তার হওয়া ইউএনওর বাসভবনের নৈশপ্রহরী নাদিম হোসেন পলাশকে ঘিরে তদন্ত অব্যাহত রেখেছেন।
মালি রবিউলের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পুলিশ জানায়, রবিউল ইসলাম ফরাসের বাড়ি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার বিজোড়া গ্রামে। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবনে গত বছরের শেষে অস্থায়ী মালি হিসেবে নিয়োগ পান। চার মাস আগে মালি রবিউল ইউএনও ওয়াহিদার বাসা থেকে একটি লাগেজ তার কার্যালয়ে পৌঁছে দেওয়ার সময় সেখান থেকে ৫০ হাজার টাকা খোয়া যায়। এই ঘটনাটি ইউএনও ওয়াহিদা জেলা প্রশাসককে জানালে জেলা প্রশাসক মালি রবিউল ইসলাম ফরাসকে সাময়িক বরখাস্ত করে জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে নিয়ে আসেন। তবে, সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও রবিউল চুরির কথা স্বীকার করেননি। পরে সিসিটিভি ফুটেজে শনাক্ত হয়, তিনিই টাকা চুরি করেছেন। ওই ঘটনায় রবিউল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়। ওই ঘটনার প্রায় আট মাস আগে তিনি জেলা প্রশাসকের বাংলোতে কাজ করতেন তিনি। সেখানে তার কাজ সন্তোষজনক না হওয়ায় ঘোড়াঘাট উপজেলায় বদলি করা হয়। রবিউলের এক ভাই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে জেলা প্রশাসনের একটি অফিসে কর্মরত। পুলিশ তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্যও বলেন, ‘রবিউল ইউএনওর অফিসের মালি ছিলেন। তিনি সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত আছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল ঘটনার দায় স্বীকার করেছেন। তার বক্তব্য অনুসারে এই হামলায় ব্যবহৃত হাতুড়ি এবং মই জব্দ করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে সেগুলো মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। ঠিক কী কারণে রবিউল হামলা চালিয়েছেন, এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তাকে রিমান্ডে নিয়ে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ঘটনায় অন্য কেউ জড়িত আছেন কিনা, তা খুঁজে বের করা হবে।’
‘ইউএনওর বাসভবনে লাগানো সিসি ক্যামেরার ফুটেজে যে ব্যক্তিকে দেখা যায়, সেই ব্যক্তির দৈহিক গড়ন ও হাঁটা-চলার সঙ্গে সন্দেহভাজন কর্মচারী রবিউলের অনেক মিল রয়েছে। পুলিশ আরও কয়েকটি দিক থেকে বিষয়টি যাচাই করে দেখছে।’
অন্যদিকে নৈশপ্রহরী পলাশকে সিসিটিভিতে হামলার আগে-পরে মই নিয়ে নানা তৎপরতা দেখা যাওয়ার কারণে তাকেও সন্দেহ করছে পুলিশ।
ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় নৈশপ্রহরী সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে ইউএনও ওয়াহিদার বাবা ওমর আলীর চিৎকার শুনে নৈশপ্রহরী নাজিম দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে তালা দেখতে পান। এরপর তিনি মই বেয়ে পশ্চিম পাশের বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে ভেতরে ঢুকে অবস্থা দেখে চিৎকার শুরু করেন।’
সান নিউজ/আরএইচ/এআর