বিজিবির অভিযানে আটক পাচারকারী ও অস্ত্র-মাদকদ্রব্য
অপরাধ

মাদক-অস্ত্র-স্বর্ণ-হুন্ডি পাচারে বিএসএফের সহায়তা!

রাশেদুর রহমান রাশু:

বেনাপোল (যশোর): যশোরের বিভিন্ন সীমান্তপথে ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য, স্বর্ণ, হুন্ডি ও অস্ত্র বাংলাদেশে পাচারে ভারতীয় বিএসএফ ও পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তার অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এ অভিযোগ করে বলছেন, ভারতের সঙ্গে যশোরের ৭০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে বিজিবি বিওপি ও টহলরত সৈনিকের সংখ্যা বাড়ালেও চোরাকারবারিরা চোরাগুপ্তা পথ দিয়ে মাদক-অস্ত্র-স্বর্ণ-হুন্ডির চালান নিয়ে দেশে প্রবেশ করছেন। ভারতীয় সীমানা লাগোয়া অসংখ্য ফেনসিডিল কারখানা ও গাঁজার বাগান থেকে এ দেশে অবাধে মাদক চোরাচালান চলে এলেও সেগুলো নির্মূলে সে দেশের সীমান্তরক্ষী ও পুলিশ বাহিনীর কোনো তৎপরতা নেই। করোনাকালে সীমান্তের হতদরিদ্র মানুষেরা কোনো কাজ না করতে পেরে চোরাচালানে জড়াচ্ছেন বলেও দাবি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও জনপ্রতিনিধিদের।

গত এক বছরে এসব সীমান্তপথে ২০৩ জন চোরাচালানিকে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য, স্বর্ণ ও অস্ত্রসহ আটকের তথ্য দিয়ে বিজিবি বলছে, আসামিদের আইনের আওতায় আনা হলেও কয়েকদিন যেতে না যেতেই আইনের ফাঁক-ফোকর গলে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর নতুন উদ্যমে মাদকপাচারে নেমে পড়েন।

বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষাকারী সংস্থাটি বলছে, এসব সীমান্তপথে ভারত থেকে মাদকদ্রব্য ও অস্ত্রের চালান দেশে প্রবেশ ও দেশ থেকে ভারতে পাচাররোধে নানাবিধ পন্থা অবলম্বন করছেন তারা। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাদকদ্রব্য ও স্বর্ণপাচার বন্ধে চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।

বিজিবির পাশাপাশি মাদকপাচারের বিরুদ্ধে সীমান্তবর্তী এ দেশের থানাগুলোর পুলিশও কাজ করছে। তাদের হাতেও মাঝে মাঝে ফেনসিডিলসহ পাচারকারী আটক হয়ে থাকেন।

বিজিবি ও থানা পুলিশ সূত্রের দাবি, সীমান্তে বসবাসরত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো করোনাভাইরাস চলাকালে অন্য কোনো কাজ না পেয়ে সীমান্ত এলাকায় সহজে বহনযোগ্য ও লাভজনক ফেনসিডিল ও স্বর্ণপাচারে জড়িয়ে পড়ছেন।

আবার বেনাপোল সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারীরা বলছেন, ‘সীমান্তে মাদক, অস্ত্র, স্বর্ণ ও হুন্ডিপাচারের সময় ধরা পড়েন কেবল সামান্য কমিশনভোগী বহনকারীরা। নেপথ্যের রাঘববোয়াল চোরাকারবারিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে না। কারণ, চোরাচালানের পণ্য নিজেরা বহন না করায় তাদেরকে হাতেনাতে আটক করা সম্ভব হয় না। যে কারণে বার বার চোরাচালান সামগ্রী জব্দ হলেও এসবের মালিকদেরকে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না।’

বিজিবি সূত্র বলছেন, ‘একটি চোরাইপণ্য জব্দের পর আমরা সেই আসামিকে থানায় দিয়ে দেই। থানা পুলিশ তদন্ত করে দেখে, এর সঙ্গে আর কারা কারা জড়িত। তদন্তের পর মূল আসামি বা রাঘববোয়ালদের আটকের দায়-দায়িত্ব আসলে থানা পুলিশের।’

গত এক বছরের অভিযানে বিজিবি যশোরের শার্শা-বেনাপোল সীমান্ত থেকে ১৩টি পিস্তল, ২৪টি ম্যাগজিন, ৫৮ রাউন্ড গুলি, ২৫.৪১ কেজি স্বর্ণের বার, ২০ হাজার ৮২৭ বোতল ফেনসিডিল, ৫৪৭ কেজি গাঁজা, ৪০৬ বোতল মদ, ৫৬৭ পিচ ইয়াবা ও ৪০ গ্রাম হেরোইন জব্দ করেছে। জব্দকৃত সামগ্রীর মূল্য ১৭ কোটি ৭৫ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা। এ সময় এসব মাদকপাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০৩ জনকে আটক করেছেন বিজিবি সদস্যরা।

বেনাপোল পৌরসভার কাউন্সিলর সীমান্তবর্তী সাদিপুর গ্রামের বাসিন্দা আসাদুজ্জামান বকুল বলেন, ‘যশোরের সঙ্গে ভারতের প্রায় ৭০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে। বাংলাদেশের এসব সীমান্তের বিপরীতে ভারতীয় সীমানার গ্রামগুলোতে ফেনসিডিলের ছোট ছোট কারখানা তৈরি হয়েছে। আবার সেখানে অবাধে গাঁজার চাষ হয়ে থাকে। সাধারণত সীমান্তের গ্রামগুলোতে ফেনসিডিল উৎপাদন আর মাঠগুলোতে গাঁজার চাষ হয়ে থাকে, যেন সহজে সেসব অবৈধ মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে পাচার করা যায়। ভারতীয় পুলিশ, বিএসএফ ও প্রশাসন এসব তথ্য জানলেও কিছু বলেন না।’

তার অভিযোগ, ‘ভারতীয় প্রশাসন চান যে, ফেনসিডিল গাঁজা হেরোইনসহ মাদকদ্রব্য সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করুক। তারা বাংলাদেশে এ ধরনের মাদকদ্রব্য পাচারে সহযোগিতা করেন এজন্যই যে, এ দেশের যুবসমাজ যেন ধ্বংস হয়ে যায়। একটি পরিবারে একজন মাদকসেবী থাকা মানে সেই পরিবারটির ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া। একটি পরিবার যখন ধ্বংস হয়, তখন ক্রমান্বয়ে পুরো সমাজই ধ্বংস হয়ে যায়।’

‘এভাবে আস্তে আস্তে মাদকদ্রব্যের বিস্তারে আমাদের দেশের সমাজকে ধ্বংসে সহযোগিতা করছেন ভারতীয় পুলিশ, প্রশাসন ও বিএসএফ। তাদের প্রশাসন যদি সীমান্ত এলাকায় গড়ে ওঠা ফেনসিডিলের ছোট ছোট কারখানা ও গাঁজার বাগানগুলো ধ্বংস করে দিতেন, তাহলে সেসবের চালান বাংলাদেশে প্রবেশ করতো না।’

আসাদুজ্জামান বকুল মনে করেন, এসব সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ মাদকদ্রব্যের চালান ঢোকা বন্ধ করা বিজিবি ও পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। সামাজিকভাবেও যদি এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়, তবেই এসব মাদক ভারত থেকে আসা বন্ধ করা সম্ভব, না হলে সেগুলোর পাচার হতেই থাকবে।’

বেনাপোল পোর্ট থানার পুটখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাদিউজ্জামান বলেন, ‘আমাদের পুটখালী সীমান্ত দিয়ে মাঝে মাঝে ফেনসিডিলের চালান দেশে প্রবেশ করে। বিজিবির হাতে ধরাও পড়ে। তখনই বোঝা যায় যে, এখনো ফেনসিডিল ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে।’

‘করোনাভাইরাসের কারণে অনেক মানুষ এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। সংসার চালানোর সহজ পথ হিসেবে ভারত থেকে ফেনসিডিল আনাটাকেই তারা বেছে নিয়েছেন। কম সময়ে বেশি টাকা পাওয়া যায় বলেই তারা এই পথে নেমেছেন। তবে এসব ফেনসিডিলের চালান যারা ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন, তারা ফেনসিডিলের আসল মালিক নন। তারা আসলে বহনকারী, ব্যাগপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা পেতে ফেনসিডিলের চালান ভারত থেকে নিয়ে আসেন।’

তিনিও মনে করেন, ফেনসিডিল বা অন্য কোনো মাদক যেন এসব সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করে থাকেন বিজিবি সদস্যরা। সীমান্ত এলাকায় আধুনিক সরঞ্জাম, নদীতে টহল দিতে হাই স্পিডবোট, কাদা-মাটিতে চলতে আধুনিক মোটরসাইকেল, রাতে চোরাকারবারিদের দেখতে নাইটভিশন ক্যামেরা ব্যবহার করেন তারা। আসলে এ সীমান্তপথে মাদক পাচার প্রতিরোধে ভারতীয় বিএসএফ একটু সহায়তা করলেই ফেনসিডিলসহ অন্য মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে প্রবেশ করতো না।’

‘কেউ গরু আনতে ভারতীয় সীমানায় গেলে গুলি করে মেরে ফেলেন বিএসএফ সদস্যরা। অথচ আজ পর্যন্ত কখনো শুনিনি যে, কোনো মাদকপাচারকারীকে গুলি করেছেন তারা। ভারতীয় বিএসএফ বা পুলিশের সহযোগিতা না থাকলে কোনো মাদকদ্রব্য এ দেশে কখনোই প্রবেশ করতে পারতো না। আমাদের সীমান্তে মাদকপাচারের বিরুদ্ধে বিজিবি যতোই চেষ্টা করুক না কেন, যতোদিন পর্যন্ত ভারতীয় প্রশাসন মাদকপাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে না তুলবেন, ততোদিন পর্যন্ত এ সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল বা অন্য মাদকদ্রব্যের চালান বন্ধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তারপরও বিজিবি সদস্যরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’

সর্বশেষ গত বুধবার (০৯ সেপ্টেম্বর) ভোররাতে শার্শা উপজেলার বেনাপোলের রঘুনাথপুর ও শালকোনা সীমান্ত থেকে ১১টি পিস্তল, ২২টি ম্যাগজিন ৫০ রাউন্ড গুলি ও ২৪ কেজি গাঁজাসহ তিন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে বিজিবি। পরে বেনাপোল সদর কোম্পানি ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে বিজিবির গত এক বছরের সাফল্যের তথ্য তুলে ধরেন যশোর ৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সেলিম রেজা।

তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা জানতে পারেন যে, দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তের কিছু মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী বিভিন্ন কৌশলে ভারত থেকে মাদক ও অস্ত্র এনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে বিক্রি করছেন। একইসঙ্গে স্বর্ণ ও হুন্ডির চালান পাচার করছেন। এ ধরনের মাদক, অস্ত্র, স্বর্ণ ও হুন্ডি পাচারকারীদের চিহ্নিত করে সীমান্ত এলাকায় গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়।

যার ধারাবাহিকতায় শার্শার শালকোনা সীমান্তে অভিযান চালিয়ে তিন মাদক ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান (১৯), রিয়াদ হোসেন (২২) ও সবুজ হোসেনকে (২৮) ২৪ কেজি গাঁজাসহ আটক করা হয়। রঘুনাথপুর সীমান্তে জব্দ হয় অস্ত্র-গুলি-ম্যাগজিন।

সান নিউজ/ এআর | Sun News

Copyright © Sunnews24x7
সবচেয়ে
পঠিত
সাম্প্রতিক

ঝালকাঠিতে চিন্ময় ব্রহ্মচারীর মুক্তির দাবি

ঝালকাঠি প্রতিনিধি: সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্...

চট্টগ্রামে হামলায় আইনজীবী নিহত

জেলা প্রতিনিধি : চট্টগ্রামে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর মু...

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলামকে 'গার্ড অব অনার' প্রদান

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : কুষ্টিয়ার মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কা...

সমুদ্র বন্দরে সতর্ক সংকেত

নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্...

চিন্ময় কৃষ্ণকে হেফাজতে নিল সিএমপি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপা...

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ১৪

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ফিলিস্তিনের গা...

লেবাননে ইসরায়েলি হামলায় নিহত ২২

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: লেবাননজুড়ে ইসর...

আলী যাকের’র প্রয়াণ

নিজস্ব প্রতিবেদক: আজকের ঘটনা কাল...

টিভিতে আজকের খেলা

স্পোর্টস ডেস্ক: প্রতিদিনের মতো আজ...

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রতি সপ্তাহের...

লাইফস্টাইল
বিনোদন
sunnews24x7 advertisement
খেলা