সান নিউজ ডেস্ক:
মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বানিয়েছিল বহুল আলোচিত ও বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমদু ভূঁইয়া। মালয়েশিয়াসহ থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে তিনি পাচার করেছেন সাড়ে আট কোটি টাকা। এসব অর্থ তিনি আইয়ুব রহমান, আবু ইউনুস ওরফে আবু হায়দার, দীন মজুমদারসহ অজ্ঞাত ব্যক্তিদের মাধ্যমে পাচার করেছেন। গত ১০ বছরে এই তিন দেশে খালেদের ৭০ বার যাতায়াতের তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি।
অনুসন্ধানে ঢাকায় তার তিনটি ফ্ল্যাটের সন্ধানও পাওয়া গেছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর রোববার (৭ জুন) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে সিআইডির পরিদর্শক ইব্রাহীম হোসেন বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।
সিআইডি’র সূত্র জানায়, সিআইডি প্রধানের নির্দেশনায় গত ১৫ মার্চ থেকে খালেদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধানে খালেদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে কমলাপুরের রেলভবন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ঢাকা ওয়াসার ফকিরাপুল জোন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সব প্রকল্পের কাজের টেন্ডার একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি।
এসব সংস্থার কাজ নিজের প্রতিষ্ঠান ভূঁইয়া অ্যান্ড ভূঁইয়া ডেভেলপারস লিমিটেড, অর্ক বিল্ডার্স ও অর্পণ প্রপ্রার্টিজের মাধ্যমে করাতেন। অন্য প্রকল্পের কাজের জন্য ঠিকাদারদের কাছ থেকে দুই থেকে ১০ শতাংশ হারে নগদ কমিশন (চাঁদা) আদায় করতেন খালেদ।
সিআইডির অনুসন্ধানে বলা হয়েছে, খালেদ রাজধানীর মতিঝিল, সবুজবাগ, খিলগাঁও, কমলাপুর, মালিবাগ, শান্তিনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ মাছের বাজার, কোরবানির পশুর হাট, সিএনজি স্টেশন, গণপরিবহন ইত্যাদি খাত থেকে ভীতি প্রদর্শন করে অর্থ আদায় ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অপরাধলব্ধ আয় করেন। এই অর্থ দিয়ে তিনি ১৯৫ নম্বর শাজাহানপুরে (ফ্ল্যাট নম্বর এ-৪) আরবি বিল্ডার্সের একটি সাড়ে বারো শ’ স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট, গুলশান-২ নম্বরে (সড়ক ৫৯, বাসা ৪, ফ্ল্যাট নম্বর এ-৩) সাড়ে তিন হাজার স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট ও মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাগ হাউজিংয়ে (ব্লক বি, রোড ২, বাসা নম্বর ১৫) একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন।
এছাড়া, তার নামে একটি প্রাডো (২০১৬ মডেল, ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৯৬৯৭) ও একটি নোয়াহ (২০১৪ মডেল, ঢাকা মেট্রো চ-১৫-৮০৫১) গাড়ি রয়েছে। খালেদ তার অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ জনৈক আইয়ুব রহমানের মাধ্যমে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে পাচার করেছেন।
সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর গুলশান থানায় খালেদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মানি লন্ডারিং মামলার বরাতে তার কাছ থেকে মালয়েশিয়ার মাই ব্যাংক ও আরএইচবি ব্যাংকের একটি করে এটিএম কার্ড, সিঙ্গাপুরের ইউওবি ব্যাংকের একটি এবং থাইল্যান্ডের ব্যাংকক ব্যাংকের একটি এটিএম কার্ড জব্দ করা হয়। ওই কার্ডগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান করে সিআইডি জানতে পারে, মালয়েশিয়ার মাই ব্যাংক ও আরএইচবি ব্যাংকের কুয়লালামপুর শাখায় চারটি হিসাবে খালেদের নামে গত বছর পর্যন্ত সর্বমোট স্থিতির পরিমাণ ছিল ২৫ লাখ ৫৭ হাজার মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত। তার পাসপোর্টের (নম্বর বিএম০২৮৯২৮১) ৩১ নম্বর পৃষ্ঠায় মালয়েশিয়ার একটি ভিসা (নং পিই০৫১১১৬৪) রয়েছে। ভিসাটিতে এমওয়াইএস এমওয়াই টু হোম লেখা রয়েছে, যা সেকেন্ড হোম হিসেবে পরিচিত।
সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, সিঙ্গাপুরে খালেদের অর্পণ ট্রেডার্স প্রাইভেট লিমিটেড (রেজি নম্বর-২০১৭৩০২৭/৭ডব্লিউ) নামে একটি ইলেকট্রনিক্স পণ্য বিপণন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তিনি ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংক, সিঙ্গাপুর শাখায় একটি চলতি হিসাব খুলেছিলেন। ওই অ্যাকাউন্টে গত বছর পর্যন্ত পাঁচ লাখ পাঁচ হাজার সিঙ্গাপুর ডলারের স্থিতি ছিল। সিঙ্গাপুরে তার শেয়ার হোল্ডার জনৈক আবু ইউনুস ওরফে আবু হায়দার ও আইয়ুবুর রহমানের সহায়তায় হুন্ডির মাধ্যমে এসব টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করেন। এছাড়া, খালেদ ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে নিজের নামে ব্যাংকক ব্যাংকে একটি হিসাব খুলে সেখানে ১০ লাখ থাই বাথ জমা রাখেন।
সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, তিন দেশে খালেদের মোট আট কোটি ৫০ লাখ টাকা সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে।
সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের পুলিশ সুপার মোস্তফা কামাল বলেন, ‘গুলশান থানার মানি লন্ডারিং মামলার সূত্র ধরে আমরা অনুসন্ধান করে খালেদের অর্থপাচারের নতুন কিছু তথ্য হাতে পাই। এসব তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর আমরা নতুন করে মানি লন্ডারিং আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করেছি। মামলার তদন্ত শেষে আদালতে শিগগিরই চার্জশিট দেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে গুলশানের বাসা থেকে আটক করা হয় যুবলীগ দক্ষিণের নেতা খালেদ মাহমুদ ভঁইয়াকে। সর্বশেষ মামলাসহ আটকের পর থেকে তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য, অস্ত্র, মানি লন্ডারিং, বৈদেশিক মুদ্রা আইনে গুলশান ও মতিঝিল থানায় মোট সাতটি মামলা দায়ের করা হয়।